অন্ধকারের পদধ্বনি
অন্ধকারের পদধ্বনি
প্রবাল দাশগুপ্ত
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের
উপর ২২ এবং ২৩ মার্চ দু দিন ধরে বেনজির হামলা চালাবার জন্যে সেখানে বেআইনিভাবে
ফিরে আসা উপাচার্য আপ্পারাও পোডিলে এবং তাঁর সহযোগীদের তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছি।
দলিত ছাত্র রোহিত
ভেমুলাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার গুরুতর অপরাধে যারা আদালতে অভিযুক্ত তাদের
অন্যতম এই আপ্পারাও পোডিলে। তাঁর প্রশাসনকে এমনকি কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের
প্রাথমিক পরিদর্শক কমিটিও দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। পোডিলে ছুটি নিয়ে সরে
গিয়েছিলেন; তিনি জানতেন, ওই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক
কুমার রূপনওয়াল পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করছেন, সে কমিটির প্রতিবেদন জমা পড়বে এপ্রিলে। লেখাপড়ার
আর আইন কানুনের যখন বারোটা বেজে গেছে তখন তিন দফা অভিযোগের জবাব দেওয়ার কী দরকার?
অভিযুক্ত ব্যক্তি সদর্পে নিজের গদিতে ফিরে আসতে পারে – তার আগে একটু ভক্ত
সহপ্রশাসকের সঙ্গে চক্রান্ত করে নিতে হয়। নিয়মানুযায়ী নিযুক্ত অস্থায়ী উপাচার্যকে অন্ধকারে
রাখাটা তো তুচ্ছ ব্যাপার। দিবালোকের চেয়ে উজ্জ্বল ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ঝলমলে
টেলিভিশনও চক্রান্তে শামিল হয়ে যায় এই বিশেষ ফরমুলার অন্ধকারে। তার পিছনে
রাষ্ট্রশক্তির অশুভ মদত থাকায় পুলিশও জুটে যায় আইনকে কলা দেখানোর এই মহাযজ্ঞে যোগ
দিতে। জাতের খেলা চলছে জানেন না বুঝি। তেলাঙ্গানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর
রাওয়ের ও তাঁর ভেলামা জাতের সঙ্গে কাম্মা জাতের জোট বাঁধার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যে
কাম্মা জাতের মানুষ উপাচার্য পোডিলে এবং ওই রাজ্যের প্রভাবশালী টেলিভিশন চ্যানেলের
মালিকবৃন্দ – এবং তেলুগু দেশমের চন্দ্রবাবু নাইডু বা বিজেপির ভেঙ্কাইয়া নাইডুর মতো
নেতারা। জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির সঙ্গে বন্ধুত্ব না করলে তেলাঙ্গানার চন্দ্রশেখর
রাও কী করেই বা অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুর উপর টেক্কা মারবেন? এদিকে লোকেরা
খেপে উঠে বিধানসভায় চেঁচামেচি করলে ২৫ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী কাম্মাদের সঙ্গে নিজের
তফাতের উপর জোর দিতেও বাধ্য হন, কিন্তু মনে তো হচ্ছে এহ বাহ্য, ওই দূরত্ব পরে
সুবিধে বুঝে কমাতেও হবে ওঁকে।
এই দাপটের জ্যামিতির
ফলেই ২২ মার্চ আপ্পারাও পোডিলে উপাচার্যের সিংহাসনে পুনরভিষিক্ত করার পবিত্র কাজে
লাগে সংঘীদের আধ্যাত্মিক পরিচালনাধীন ছাত্র সংগঠন এবিভিপির সহিংস আস্ফালন। ওই
ক্যাম্পাসে এবিভিপির সভাপতি বুক ফুলিয়ে টেলিভিশন সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিয়ে ঘোষণা
করে, সব গোলমালের জন্যে নাকি দলিত আর বামপন্থীরাই দায়ী। অপর পক্ষের সঙ্গে কথা বলার
কোনও কারণ ওই চ্যানেলের সাংবাদিক কেনই বা দেখতে পাবে। গেট আটকা। অন্য
সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিষেধ, তাছাড়া দোলে তারা অনেকেই মাতোয়ারা। ক্যাম্পাসের
ইনটারনেট অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সর্বত্র মোতায়েন, ছাত্রদের উপর যথেচ্ছ
হামলা চালানোর পরোয়ানা পেয়ে তারা দু দিন ধরে ভিন্ন স্বাদের হোলির মাতনে মত্ত।
গণিতের অধ্যাপক তথাগত সেনগুপ্ত ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়েসু রত্নম সহ পঁচিশজন
ছাত্রকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়। কয়েক ঘন্টা যারা থানায় থানায় খোঁজ
নিচ্ছে তাদের মিথ্যে কথা বলতে থাকে পুলিশ। সামাজিক মিডিয়ায় সেটা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে
দেখে অবশেষে বুধবার রাত্রে স্বীকার করে যে চের্লাপল্লীর কেন্দ্রীয় কারাগারে
রেখেছে। দাঙ্গা বাধানো প্রভৃতি নানাবিধ অলীক অভিযোগ সংবলিত নালিশনামা ততক্ষণে
প্রস্তুত।
এ তো সবে কলির
সন্ধে। কারাগারে পরিণত ওই রুদ্ধদ্বার ক্যাম্পাসে ছাত্ররা যাতে টাকা তুলতে না পারে
সেজন্যে তাদের এটিএম কার্ড অচল করে দেওয়া হয়। হস্টেলে হস্টেলে মেস বন্ধ, জল বন্ধ।
পরিস্থিতির সামাল দিতে যে ছাত্র মাঠে হাঁড়ি চড়িয়ে রান্না করছে তাকে পুলিশ বেধড়ক
প্রহার করে, বর্তমান রচনার মুহূর্তে সে ছাত্রটি হাসপাতালে, অবস্থা আশঙ্কাজনক।
দুদিন এই তাণ্ডব
চালিয়ে কীভাবে পার পেয়ে যেতে পারেন প্রমাণ করে নেবার পর কৌরববৃন্দ ২৪ তারিখে ধীরে
ধীরে অপচারের ধারা একে একে শিথিল করছেন। যেখানে ১৯৮৯ থেকে ২০০৬ পড়িয়েছি, যে
ক্যাম্পাসে লেখাপড়ার কিছু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সমবেত কাজে যোগ দিয়েছি, সেই
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহাল দশা দেখে আমার কীরকম লাগছে সেসব অবাস্তব কথা জেনে
কী করবেন। কোথাও যা সম্ভব নয় বলে জানতাম তাও দেখতে হল আমার ক্যাম্পাসের বর্তমান
বাসিন্দাদের। শুধু ধিক্কার দেবেন না। একটু স্তম্ভিত হতেও পারছেন আশা করি। বিজন
ভট্টাচার্যের কণ্ঠে বলা রবীন্দ্রবাক্য স্মরণ করুন ঋত্বিকের ছবি থেকে: ‘রাত কত হল?
উত্তর মেলে না।’
0 Comments:
Post a Comment
Subscribe to Post Comments [Atom]
<< Home