Sunday, December 16, 2012

Goddo o Bonkimcandro: Ubhoshanketoner prostaabonaa: PROTHOM KISTI


গদ্য ও বঙ্কিমচন্দ্র: উভসংকেতনের প্রস্তাবনা

প্রবাল দাশগুপ্ত

।।ভণিতা।।

সেই অতীতই স্মরণে আনবার মতো যার সঙ্গে বর্তমানের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল মুহূর্তের প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। এই কথা ভেবেই ভাষার ইদানীন্তন ভাষ্যের প্রসঙ্গে আমাদের আলোচনা শুরু করছি।
পুণ্যশ্লোক রায় তাঁর “ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্যাণ্ডার্ডাইজেশন” বইয়ে (যাবতীয় উল্লেখের খুঁটিনাটি আকরপঞ্জিতে দেওয়া হয়েছে) প্রস্তাব করেন, ভাষার চালচিত্রে দুটো ব্যাপার বিশেষ জরুরি: বক্তা আর শ্রোতা দুজনেরই জানা কিছু অভিন্ন জায়গা আছে, সেটা প্রস্থান, তার অভাবে ভাষা অসম্ভব হত; আর এমন জায়গা আছে যা একজন জানে, অন্যজন জানে না, দুপক্ষের জানার এই ভিন্নতা যদি না থাকত তাহলে ভাষার কোনো দরকারই থাকত না। ভাষার যে প্রয়োগরীতি অভিন্নকেই ফুটিয়ে তোলে তাকে বলি কবিতা। যে রীতি ভিন্নের উপর জোর দেয় তার নাম গদ্য।
আমার গুরু তথা পুণ্যশ্লোকের বন্ধু অশোক কেলকর পুণ্যশ্লোকের এই বক্তব্যের জের টেনে আরো বলেন, যে কায়দা ভিন্নতার উপর খুবই বেশি জোর দেয় সেই ধরনের গদ্য বৈশেষিক বা টেকনিকাল গদ্য। তার বৈশিষ্ট্য হল পরিভাষা প্রয়োগ করতে করতে, সংজ্ঞার্থ দিতে দিতে, সমানে বলে যাওয়া যে পাঠককে এই শব্দগুলোর ঠিক এই এই অনুধাবন মেনে চলতেই হবে।
লক্ষ করা ভাল যে কেলকর কিন্তু বৈশেষিক কবিতা সম্ভব না অসম্ভব এ নিয়ে কথা বাড়াননি। ধরেই নিয়েছেন যে দূরত্ব রচনার জায়গাটা যে গদ্য সেকথা তো পুণ্যশ্লোক প্রতিপাদন করেই দিলেন, কাজেই কবিতা নিয়ে ওভাবে ভাববার কোনো দরকারই যে নেই এটা তো এখন থেকে জানা কথা। অথচ লোকেদের কথা বাড়াতে দেখেছি ভালোও লাগে। কারুর নির্ঘাত বলে উঠতে ইচ্ছে করবে, আচ্ছা, প্রাচীন ভারতে তো প্রচুর তাত্ত্বিক তাঁদের ভাষ্যরচনা পদ্যেই লিখেছেন, যেমন বাক্যপদীয়-প্রণেতা ভর্তৃহরি, তুমি কোন সাহসে বলছ ওই বয়ানগুলো কবিতাপদবাচ্য নয়?
এইখানে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান শিশিরকুমার দাশ। “গদ্য ও পদ্যের দ্বন্দ্ব” গ্রন্থে তিনি বলেন, গদ্যই ভাষার সেই রচনারীতি যা অধিভাষা বা মেটাল্যাঙ্গুয়েজের কাজ করতে পারে। রায়, দাশ, কেলকর, এঁরা কেউই বলছেন না যে পদ্যের কায়দায় রচিত কোনো বয়ান বৈশেষিক হতে কিংবা পরিভাষা ব্যবহার করতে অপারগ – ওরকম অদ্ভুত কথা কেউ বললে সে দাবি খণ্ডন করতে প্রতিপক্ষের এক মুহূর্তও লাগবার কথা নয়। ব্যাপারটা যা দাঁড়াচ্ছে তা হল, প্রথমত, পরিভাষা-কণ্টকিত বক্তব্যবাহী পদ্য কিন্তু রসাত্মক কাব্যের বাহনের কাজ করতে পারে না। আর দ্বিতীয় কথা, এমনকি কাব্যেতর বয়ান হিসেবেও পদ্যে রচিত কোনো পরিভাষা-বিদ্ধ বৈশেষিক বয়ানের পক্ষে সম্ভব নয় অধিবয়ানের ভূমিকায় নেমে বয়ানবিষয়ক কোনো দস্তুরমতো অধিবক্তব্য পেশ করা।
এ কাজটা ঠিক কেন অসম্ভব? কারণ, পদ্যের পদ্যত্ব রক্ষা করতে গিয়ে ওই বয়ানকে কিছু ভূষণ অঙ্গে ধারণ করে নাচতে হয়। সেই ভূষণাদি আস্ত রেখে বয়ান পূর্ণাঙ্গ নিখুঁত উদ্ধৃতি দেওয়ার মতো পদক্ষেপ করতে উদ্যত হলেই তার নাচের তাল কেটে যায়। দুটো চেষ্টার প্রয়োজনের মধ্যে এমন অসংগতি আছে যা কোনো ব্যক্তির রচনানৈপুণ্য থাকা না থাকার উপর নির্ভর করে না। এই ব্যক্তিনিরপেক্ষ নীতিগত কারণেই পদ্যধৃত বৈশেষিক বয়ানের পক্ষে কোনোরকম অধিবয়ানগিরি করা অসম্ভব।
রায় আর কেলকরের প্রজন্মের কাব্যচিন্তা গড়ে উঠেছিল মোটের উপর রোমান য়াকবসন-বিরচিত (১৯৬০) কাব্যতত্ত্ব ধোপে টিঁকবে ধরে নিয়ে। সে-ভাষ্যের গভীর আকরণিক সমস্যা তাঁদের প্রজন্মের চোখে পড়েনি। পরবর্তী পর্বের কাজে-কর্মে, যেমন বিভঙ্গতত্ত্বের সূত্রস্থাপনে (দাশগুপ্ত ২০১০, ২০১৩), তার খানিকটা বহিরঙ্গ সুরাহা করা যায় ঠিকই; করতে পারছি ভেবে ভালো লাগাও বিচিত্র নয়। কিন্তু ওভাবে কি আর সত্যিই তত্ত্বের মুশকিল আসান হয়। একেকটা দলিলের – এবং যে প্রণেতা অথবা যে সমবায় সেই দলিলের ব্যক্তিগত কিংবা অপৌরুষেয় দায়িত্ব নিয়েছে সেই মানবজমিনখণ্ডের – সসীম স্থানাঙ্ক আর কালাঙ্কই পরবর্তী যুগের পাঠকদের অনুধাবনরীতির পক্ষে জরুরিতম, এই ধারণাটাই বসে থাকে বিভঙ্গতত্ত্বের মতো য়াকবসন থেকে সরে আসা উত্তরসাধনাতেও। ওই দলিলডাঙার সীমা যদি সত্যিই ভাঙতে চায় কোনো সাহিত্যতত্ত্ব, তাহলে সেই তত্ত্বপথের পথিকের পক্ষে আজকের দিনেও সেই বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ করা জরুরি হয়ে দাঁড়ায় যিনি স্রেফ আনন্দমঠের তথা বন্দে মাতরমের প্রণেতা নন, যিনি গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি করার অবহেলিত জায়গাটাতে অমূল্য অবদান রেখে গেছেন। তার উপর আলোকপাত না করলে আমরা বঙ্কিমের কেন, কারুর গদ্যই বুঝতে শেখার তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করতে পারব না। কাজটা কঠিন। আজকের দিনের তাত্ত্বিকদের পক্ষে এই আবাদ শুরু করাই সম্ভব, ফসল তোলা আশাতীত। সেইজন্যে বঙ্কিমের গদ্য নিয়ে লিখতে বসে মনে হল জোরের সঙ্গে বলা দরকার যে গদ্যের স্বরূপ আমরা জানি বলে ধরে নিয়ে এগোতে পারি না। গদ্যের নির্বিশেষ ভাষ্য রচনার সুকঠিন কাজে বঙ্কিমের মতো পথিকৃৎ আমাদের কী সাহায্য করতে পারেন সে প্রশ্নটা অনেক বেশি জরুরি।
কবিতার চেয়ে গদ্যের তত্ত্ব রচনা করা কঠিন কাজ এই বক্তব্যে সায় দিতে কোনো কোনো পাঠকের হয়তো অসুবিধে হবে। হতেই তো পারে। সেরকম পাঠকের হয়তো কাজে লাগবে “ল্য দির এ ল্য দি” (দ্যুক্রো ১৯৮৪)। আমি নিজে দ্যুক্রোর গবেষণা থেকে যেটুকু শিখতে পেরেছি তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছি অন্যত্র (দাশগুপ্ত ২০১০)। এখানে জের টানবার অবকাশ নেই। কোনো বড় মাপের পথিকৃৎকে নিয়ে লিখতে গেলে এমন অনেক নির্বিশেষ তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ তোলার দরকার এসে পড়ে যা সবিস্তারে খুলে বলা যায় না; এ ব্যাপারে বর্তমান লেখক দুঃখিত কিন্তু নিরুপায়। বঙ্কিমচন্দ্র যে গদ্যশিল্পে বিশ্বের পরিমাপেও ওই বহরের পথিকৃৎ এ কথাটা তো সমস্ত বাধা উত্তীর্ণ হয়ে বলতে পারা দরকার।
যে পাঠক এর পরেও তাঁকে জাতীয়তাবাদের ঘেরাটোপেই বেঁধে রাখতে চাইবেন তিনি সে চেষ্টা চালিয়ে যান না, কেই বা আটকাচ্ছে।

।।‘রাজনীতিজ্ঞ’।।

   “দুর্গেশনন্দিনী”র দ্বিতীয় খণ্ডের একাদশ পরিচ্ছেদে ওসমান বলছেন, “আপনি তো রাজনীতিজ্ঞ বটেন, ভাবিয়া দেখুন, দিল্লি হইতে উৎকল কত দূর।” হতেও পারে বাংলা গদ্যের আধুনিক প্রয়োগের ইতিহাসে এখানে রাজনীতির সঙ্গে মানসিক আর সাংস্কৃতিক জগতের অন্যান্য স্থানাঙ্কের সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস একটা নতুন পর্বে পা দিচ্ছে; নাও হতে পারে; বয়ানের পৌর্বাপর্যের বিচার ছেড়ে দিতে হবে সেই বিষয়ের বিশারদদের হাতে; তাঁদের বিচার তো শিরোধার্য বটেই। অন্য সিদ্ধান্তের পক্ষে তাঁরা জোরালো সওয়াল করতে পারেন জেনেও ঝুঁকি নিয়ে প্রস্তাব করছি যে বঙ্কিমের প্রথম উপন্যাসের এই বাক্যটাকে মানচিত্রে ঠিকমতো বসাতে পারবার জন্যে ইতিহাসরচনার নতুন এলাকা জরিপ করা দরকার। বিশেষ করে গণতন্ত্রের ভাষাগত বিশ্লেষণ আর রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সীমান্তের কিছু সূত্র নিয়ে এমন প্রশ্ন তুলতে হবে যার দিকে আমরা সম্যক মন দিইনি।

।।গণতন্ত্রের ইতিহাস আবার কে লেখে।।

ইতিহাসকে সচরাচর নামতে দেখি রাষ্ট্রের মিত্রশক্তির ভূমিকায়। অবশ্যই কোনো কোনো ঐতিহাসিককে দেখে মনে হয় এ মানুষটা নিরপেক্ষ, যেদেশে জন্মেছেন কিংবা যেখানে এসে পড়েছেন সে জায়গার বর্তমান অথবা অতীত শাসকদের নিয়ে সত্যি কথা বলতে ইনি সম্মত – এবং বলবার ক্ষমতা অর্জন করেছেন (মুনশিয়ানা এবং পেশাগত পারদর্শিতার অভাবে তো সমস্ত সদিচ্ছাই ব্যর্থ হয়ে যায়)। কিন্তু এরকম লেখক আন্তরিক এবং অসমসাহসিক হলেও রচনার এমন বর্গপ্রথার অধীন যে প্রথা লেখক-পাঠকের সম্পর্কটাকে বেঁধে রাখে চুক্তির অপরিবর্তনীয় শর্তের জ্যামিতিতে। পাঠককে সে শর্ত নিয়ে যায় এমন কোনো রাষ্ট্রের দুনিয়ায় যে রাষ্ট্র ওই ঐতিহাসিকের রচনাবলি (কিংবা সেসব লেখারই কোনো সহজপাচ্য পুনর্লিখন) তুলে দেবে শিক্ষকদের আর অভিভাবকদের হাতে। সেই কথা ও কাহিনি পড়ে নাকি আগামী দিনের আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠতে পারবে শিশুরা। এই কর্তব্যের ছুতো দেখিয়ে সরকারের পর সরকারকে বারবার ক্লেদাক্ত স্বার্থসিদ্ধি করতে দেখেও পাঠক ভাবতেই থাকেন যে আদর্শ রাষ্ট্র নিশ্চয়ই নীতিগতভাবে কাজটা ঠিকমতো করতে পারে বলেই আদর্শটা মূল্যবান বলে স্বীকার্য, বাস্তব জগতের শত বিচ্যুতি সত্ত্বেও। লেখক-পাঠকের শর্তের জ্যামিতির অমিত শক্তি, সেই শক্তিই পাঠককে এই স্বপ্নের দরজায় বসিয়ে রাখে।
   ইতিহাস রচনার এই ধারার সঙ্গে বিশেষ করে গণতন্ত্রের কোনো গাঁটছড়া বাঁধা আছে কি? রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বরূপের বিচারে গণতন্ত্র ইতিহাস-সঞ্জাত বিকল্প মাত্র। এমন নয় যে দুনিয়ায় গণতন্ত্রের উন্মেষ না ঘটলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বটাই বিপন্ন হত। আজকের দিনে রাষ্ট্রবিষয়ক কথাবার্তার যা মর্জি-মেজাজ তাতে গণতন্ত্রকে সোজাসুজি কেউই যে আর খোলাখুলি উপহাসের পাত্র বলে বিবেচনা করে না সেকথা সত্যি, কিন্তু তাই বলে ধরে নিতে নেই যে চিরতরে মানুষের মন ওদিকে হেলে গেছে, কোনোক্রমেই গণতন্ত্রবিরোধী ঐকমত্য ফিরে আসবে না মানুষের বিচারমঞ্চে। কিছু কিছু ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াবশত এই ঝোঁকটার শক্তিবৃদ্ধি ঘটেছে; পালটা প্রক্রিয়া সুযোগ পেলেই প্রবণতাটাকে উলটে দেবে।
   অর্থাৎ এই যে ভাবছি ইতিহাস রচনার একটা প্রণালি বিশেষ করে গণতান্ত্রিক মেজাজের দোসরস্থানীয়, এবং সে পদ্ধতির সূত্রে এই যে বঙ্কিমের কথাসাহিত্যে রাজনৈতিক উপাদানের পরিস্ফুটনের জায়গাটার দিকে মন দিতে চাইছি, এ চেষ্টা করার কোনো মানে হয় কিনা জিগেস করতেই পারেন। সংশয় হওয়াই স্বাভাবিক। আত্মপক্ষসমর্থনের দায় আমারই।
   আমি যা ধরে নিচ্ছি সেটা মোটামুটি এইরকম দেখতে: যেকোনো আধুনিক সমাজের নাগরিকবৃন্দের অন্যতম কাজ হল, আত্মসচেতনতার শক্তিবৃদ্ধি করতে পারবার জন্যে পরস্পরের সঙ্গে সমানে সমানে নানা দিক থেকে কথাবার্তা বলে বলে, লিখে লিখে, ছেপে ছেপে, সমবায়ের বর্তমান আর অতীতের যথাসাধ্য স্পষ্ট ছবি ফুটিয়ে তোলা, সে ছবিতে কোনো ফাঁক থাকলে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে থাকা। অর্থাৎ ধরে নিচ্ছি যে সারা সমাজের যে সংগঠিত দলিলসংগ্রহকে বলি মহাফেজখানা, সেই আর্কাইভ-দেবীর প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে উপযুক্ত লেখকদের বলা হয় কিছু দিন অন্তর পুরানো সেই দিনের কথা স্মরণ করে মহাফেজখানা থেকে বিশেষ বিশেষ দলিল তুলে এনে নতুন করে ইতিবৃত্তের বৃত্তান্ত ফেঁদে পাবলিককে খাওয়াতে। সেই পাবলিক নিজেকে বলে “আমরা যারা এদেশের জনগণ”, মহাফেজখানাকে বলে “আমাদের এই দলিলডাঙা”।
   এইরকম প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বাংলা ভাষার গদ্যরচনায় রাজনৈতিক ধারণার উপস্থিতির পালাবদলের গল্পটা আরেকটু স্পষ্ট দেখতে পাব বলে আশা করা যায়। এই সূত্রে যত দিক থেকে প্রশ্ন ওঠে তার সবগুলোর জবাব দেওয়া তো দূরের কথা, প্রশ্নের জুতসই পরিস্ফুটন অবদি পৌঁছোনোই আমাদের পক্ষে কঠিন। ধারণার ইতিহাস রচনা করার কাজটা অত্যন্ত কণ্টকিত; কোন শর্তে এ কাজ করা উচিত অনুচিত তা নিয়ে প্রাথমিক দরকষাকষির উঠোন ঝাঁট দেওয়া হচ্ছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। এজাতীয় বিশ্লেষণের চালচিত্র নিয়েই তো আলোচনা হবার কথা, তাই হচ্ছেও।
   গণতন্ত্রের ইতিহাসরচনার কাজ নিশ্চয়ই এমন জায়গায় বসে করা যায় না যেখানে সবাইকে নিঃশব্দে ধরে নিতে বলা হচ্ছে যে তুঘলকি কর্তৃত্বের দাপট আর দরকার হলে সেই ছড়ি ঘোরানোর কায়দা কানুন বজায় রাখার জন্যে অস্ত্রপ্রয়োগ চলতেই থাকবে, যেখানে সুধীবৃন্দও এই ব্যবস্থা চুপচাপ মেনে নিতে রাজি থাকবেন। হতে কি পারে যে আজকাল ঠিক এইরকম আবহেই কাজ করার জন্যে চাপ দেওয়া হচ্ছে অনেককে? বর্তমান কালের পাঠকদের কি পাঁচমিশেলি উপায়ে – কিছু সূক্ষ্ম, কিছু স্থূল উপায়ে – বলা হচ্ছে, সেই সত্য যা রচিবে ইংরেজিভাষী লেখকগণ, সেই দলিল যা ছাপিবে ইংরেজিভাষী অনুবাদকবৃন্দ? বাংলায় বা তেলুগুতে বা মারাঠিতে কাজ করতে বসেও শুধু সূত্রনির্দেশের জায়গাতেই নয়, সামগ্রিক সারস্বত আবহের মালিকানাটাই ইংরেজিভাষীদের দিয়ে দেওয়ার একটা ব্যাপার আছে, এরকম বলা চলে কি?
এ প্রশ্নটা গণতন্ত্রের ইতিহাস রচনার প্রসঙ্গে বিশেষ জরুরি। বাংলাভাষী আর সোমালিভাষী কর্মীদের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে ইংরেজিকে কেউ ব্যবহার করতে চাইতেই পারেন, কিন্তু অলঘু বিবেচকতার সঙ্গে সে কাজ করতে চাইলে এটা তো দেখতে হবে যে বাংলা থেকে ইংরেজি, ইংরেজি থেকে সোমালি, সোমালি থেকে ইংরেজি, ইংরেজি থেকে বাংলা চারটে রাস্তাতেই যথোচিত পরিমাণে বয়ান তরজমা করা হচ্ছে এবং সেইসমস্ত অনূদিত বয়ান পড়ে লক্ষ্যভাষাভাষী পাঠকেরা হজমও করছেন, তার ফলে সাংস্কৃতিক বাস্তবের সঙ্গে তাঁদের বোঝাপড়া পালটেও যাচ্ছে। অর্থাৎ দেখতে হবে যে কোনোটাতেই পরিবহণের স্রোত কারুর কারুর মতলববাজির ফলে সীমিত বা সংকুচিত হয়ে থাকছে না। যে যোগাযোগ পারস্পরিক নয় তাকে যোগাযোগ বলে মানতে রাজি হওয়া যে গণতন্ত্রের স্বভাববিরুদ্ধ, একথা বেশ কিছু ভাষ্যকারের নজর এড়িয়ে গেছে।
যে বহুভাষী পরিবেশে সমস্ত লেখক আর পাঠকই অনুবাদের পারস্পরিক, সমানুপাতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখবার সচেতন চেষ্টা করছেন, সেই পরিবেশকেই ভাবব গণতন্ত্রের শ্রীবৃদ্ধির সহায়ক। তার বদলে যদি দেখেন লোকে দু-তিনটে ভাষা নিয়ে কারবার করছে ঠিকই কিন্তু ইংরেজির মতো বিশেষ একটা মাধ্যমে অনুবাদ হলে তবেই সে দলিল মনোযোগ্য বলে ওজনদার ভাষ্যকারদের স্বীকৃতি পাচ্ছে, তখন বুঝবেন যোগাযোগের ব্যবস্থাটা বেঁকে গেছে। নিজেদের কোলে ঝোল টানছে গোষ্ঠিবিশেষ। এই বেঁকে যাওয়াটাকে বজায় রাখতে যারা সচেষ্ট তারা যে গণতন্ত্রের রাস্তাঘাট নিয়ে দখলদারির খেলায় মেতেছে, এ কথাটা আমরা অনেকেই লক্ষ করিনি। ব্যাধিটার দিকেই যদি নজর না দিই তাহলে তো স্বভাবতই এও দেখতে পাব না যে এই রোগের দাওয়াই ছিল স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের ঝুলিতে। তবে বঙ্কিমের দিকটা ক্রমশ প্রকাশ্য; দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আমার ভণিতা শেষ হয়নি; দুঃখের সঙ্গে এও জানাচ্ছি যে অধীরচিত্ত পাঠক ভণিতা ডিঙিয়ে লেখার মাঝ-মধ্যিখানে গিয়ে পড়তে শুরু করলে কোনো কথারই খেই ধরতে পারবেন না।
আপনার অধীরতা অগ্রাহ্য করছি ভাবলেন বুঝি? তা করব কেন। কার ঘাড়ে কটা মাথা। অধীরতার কারণ আন্দাজ করে চোখে চোখ রেখেই তো চলতে চাইব। আপনি কি ভাবছেন, আচ্ছা, কোনো একটা বয়ান কোন ভাষায় লেখা তা নিয়ে এ লোকটা খামখা কথা বাড়াচ্ছে কেন? আপনি হয়তো “গোলাপকে যে নামেই ডাকো সে তবু একইরকম সুন্দর থাকে” ঘরানার পাঠক? ভাষা থেকে ভাষান্তরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত এবং সমানুপাতিক রাখার কাজটা কেন জরুরি সেটা হয়তো দৃষ্টান্ত দিলে ধরতে পারবেন আরেকটু সহজে।
দেশের ইতিহাস রচনার কাজ, এবং জাতীয় শিক্ষাতন্ত্রে সেই রচনার সুলভ সংস্করণ খাইয়ে বাচ্চাদের মানুষ করার প্রক্রিয়া, একেকটা দেশের নিভৃত ব্যাপার হয়ে রয়েছে আজও। ফলে ইতিহাস রচনার তথা বিতরণের প্রত্যেকটা জাতীয় কর্মক্ষেত্রের চারপাশে উঁচু উঁচু পাঁচিল। এই প্রাচীরের বাধা অতিক্রম করার দস্তুরমতো প্রচেষ্টা করেছেন কিছু কর্মী সম্প্রতিকালে; তাঁদের কাহিনি পেশ করছি। ইতিহাস রচনার নতুন প্রতিকল্প দাঁড় করাবার অভিপ্রায়ে কয়েকজন পণ্ডিত লেখেন Historio por malfermi estontecon (হিস্তোরিয়ো পোর মালফেরমি এস্তোন্তেৎসোন, ২০০৭) – তাঁদের গ্রন্থের এই অনুবাদ সম্বল করেই এগোবে উপস্থাপন।
চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার তিন চোদ্দং বিয়াল্লিশজন ঐতিহাসিক কয়েক বছর ধরে পরিশ্রম করে ইস্কুলের মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রদের জন্যে একটা আধুনিক ইতিহাসে পাঠ্যবই লিখেছেন। সে বইয়ে বলা আছে ওই তিন দেশের গত দুশো বছরের কাহিনি। বলতে গিয়ে দেশে দেশে আলাদা খণ্ডচিত্র না এঁকে একটাই বড় ক্যানভাসের ছবি পেশ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দলিলপাঠের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনটে দেশেই ইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পূর্ব এশিয়ার আধুনিক ইতিহাস শিখতে পারবে, এই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে রচিত এ বই যুগপৎ চিনে, জাপানি আর কোরিয়ান ভাষায় প্রকাশ করা হয়। কোনো একটা ভাষার সংস্করণকে মূল বই আর অন্য দুটোকে নিছক অনুবাদ বলার অবকাশ নেই; দলিল হিসেবে তিনটেই সমান প্রামাণিক বলে গণ্য। এইখানে দেখতে পাচ্ছি যোগাযোগের পারস্পরিকতার গুরুত্ব।
ইনটারনেট ঘাঁটলে এই প্রকল্পের সূত্রপাত আর বাস্তবায়ন নিয়ে দুয়েকটা ছোট প্রতিবেদন বা মন্তব্য ইংরেজিতেও যে পাওয়া যায় না তা নয়। যেমন ধরুন এই পাতাটা পাওয়া যায়:
কিন্তু মূল তিনটে ভাষার বাইরে একটাই অনুবাদ হয়েছে। ২০০৭ সালে এ বইয়ের তরজমা প্রকাশিত হয় নিরপেক্ষ ভাষা এসপেরান্তোয়। গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ কিছু মানুষের চেষ্টায় বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সমানে সমানে ভাববিনিময়ের এই মাধ্যম একটা মুক্ত প্রাঙ্গণ হয়ে উঠতে পেরেছে। এই প্রাঙ্গণে সবার সঙ্গে সবার চিরচলিষ্ণু সংলাপের নিমন্ত্রণ। যাবতীয় সরকারের, যাবতীয় কোটিপতির বিশেষ আবদার থেকে খানিকটা দূরে বসে, স্বেচ্ছাবৃত দারিদ্র্য বরণ করে এই সংলাপে যোগ দিতে হয়। সংলাপের মারফত বিভিন্ন মানদণ্ডের সমীকরণ নির্ণয়ের এই জায়গাটাতেই যে একভাষাদর্শী কয়েকটা ইতিহাস-রচনা-ব্যবস্থার মধ্যে আলাপ-আলোচনার প্রয়াসকে তুলে ধরে অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এটা কোনো আপতিক বা কাকতালীয় ঘটনা নয়। তবু লক্ষ করতে বলব, এমনকি এরকম নিরপেক্ষ ভাষাও রাষ্ট্রসীমার এপারে-ওপারে পারস্পরিক আর সমানুপাতিক কথাবার্তার সহায় হিসেবেই কাজ করতে পারে। সেও যদি ‘আসল’ অনুবাদের অদ্বিতীয় মাধ্যম সেজে বসতে চায় তাহলে অনর্থ ঘটবেই। চূড়ান্ত বিচারের মানদণ্ড কোনো একক ভাষার হাতে তুলে দিতে পারে না গণতন্ত্র। ‘চূড়ান্ত সমাধান’-এর কল্পনা হিটলারদেরই মস্তিষ্কপ্রসূত; গণতন্ত্র ইংলণ্ডের ভাষা বা চিনের ভাষাকেও যেমন ওই সিংহাসনে বসাতে পারে না তেমনি এসপেরান্তোকেও পারে না।
আমরা তাহলে ধরে নেব যে, গণতন্ত্রের ইতিহাস লেখার কাজটা হাতে নেবার মানে হয়; এ কাজের ছোটখাট সূত্রপাত করা হয়েছে পুব এশিয়ায়; যেকোনো সূত্রপাতেই ভাষার প্রশ্নটা সামনে রাখা জরুরি, কারণ নইলে একেকটা স্থানীয় কথোপকথনের সঙ্গে স্থানান্তরের সুস্থ সম্বন্ধ গড়ে উঠবে না, সমস্ত ঘেঁটে যাবে; যদি পথগুলোকে সোজা রাখবার বিশেষ চেষ্টা না করা হয় তাহলে আন্তরিকতার আলোর কিরণকে স্বার্থের অভিকর্ষের শক্তি টেনে নিয়ে যাবেই যাবে বাঁকা পথে। আইনষ্টাইন উবাচ।
কিন্তু, কী মুশকিল, বর্তমান প্রবন্ধের পরিসরে ভাষার প্রশ্ন তোলা বলতে কীই বা বোঝায়? বঙ্কিম তো বাংলাতেই লিখতেন। তাহলে? এরকম খটকা লাগতেই পারে। এর জবাব দেবার সূত্রে আমরা ‘ভাষা’ বলতে যা বুঝি সেই ধারণাটার পুনর্বিবেচনা করার দরকার এসে পড়ে।

0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]

<< Home