Sunday, December 16, 2012

Goddo o Bonkimcandro: Ubhoshanketoner prostaabona: DITIYO KISTI


।।ভাষার প্রশ্নটাকে ঢেলে সাজানো।।

   আমরা ধরে নিই বটে যে জানি কে একটামাত্র ভাষা জানে, কে একাধিক ভাষা শিখেছে, জানি কাকে বলে এক ভাষা থেকে ভিন ভাষায় অনুবাদ। কিন্তু চেপে ধরলে দেখতে পাই, আসলে কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখিনি ঠিক কী নিয়ে কী বলছি এবং বলবার পরোয়ানা পাচ্ছি কোত্থেকে। “দিনমণি অস্ত গিয়াছে”ও বঙ্কিমের উপন্যাসে বাংলা গদ্য বলে গণ্য, “মিনসের কথার কী ছিরি, মাগো”ও তাই? এদুটো যদি একই ভাষা হয় তাহলে আলাদা বলব কাকে?
   ভাষার আধারে কথাবার্তার পাশাপাশি লিখিত বয়ানও থাকে। গণতন্ত্রেরই হোক আর যে তন্ত্রেরই হোক, যেকোনো ইতিহাস রচনার প্রকল্পেই দলিলের সঙ্গে কারবার আবশ্যিক। বয়ান তো প্রতিবিম্বনের অকুস্থল। বিভিন্ন বক্তা আর লেখক যে যার মতো করে কথাবার্তা আর লিপির অক্ষরেখা-দ্রাঘিমার মানচিত্রে নিজেদের বসিয়ে নেন। সেই উপস্থিতির নানাবিধ পর্যায়ের সঙ্গে বয়ানের মোকাবিলা চলতে থাকে। বিষয়টা নিয়ে যেসব প্রশ্ন ওঠে সেগুলো গুছিয়ে জিগেস করার পরিস্ফুট সরঞ্জাম পাওয়া গেছে ‘দ্বিসংকেতন’এর তত্ত্বে।
   বিষয়টা নিয়ে আলোচনা যখন শুরু হয় তখন দ্বিসংকেতন বলতে কর্মীরা বুঝতেন, সমবায় একটা ভাষাগত ঐক্যকে ধরে রেখেও সেই খেতে দুরকম ফসলের আবাদ করছে; লেখা-ভিত্তিক ‘দুর্গম’ উপসংকেতন এক মেরুতে, মুখের কথা ঘিরে গজিয়ে ওঠা ‘সুগম’ উপসংকেতন উলটো মেরুতে, দুয়ে মিলে ভাষার সংসার চলে, এই ছিল ছবিটার মোদ্দা কথা। দুই মেরুতে বিভাজিত এই ধারণার যে-ভাষ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৮৪) আর প্রমথ চৌধুরী (১৯৬৮) দিয়ে গেছেন তারই উপর নির্ভর করে রচিত হয়েছিল ফার্গুসনের (১৯৫৯) বিভিন্ন ভাষার তথ্য সংবলিত দ্বিসংকেতনের নির্বিশেষ তত্ত্ব – যার জের টেনে ফিশম্যান (১৯৬৭) দ্বিসংকেতন আর দ্বিভাষিকতার সম্পর্কের পুনর্বিবেচনার সূত্রপাত করেন। নেশন-রাষ্ট্রের পোশাকি শিক্ষাদীক্ষারই আশপাশ দিয়ে যে গ্রন্থনাত্মক-কৃতকীয় ওরফে স্ট্রাকচারাল-ফাংশনালিস্ট গবেষণা চলতে থাকে সেই সংহিতাভিত্তিক সংকেতায়নের ঘেরাটোপের মধ্যেই এ ছবিগুলো আঁকা হয়েছিল।
   ওই ঘেরাটোপ পেরিয়ে ভাষাতত্ত্বের নিজস্ব বোধভাষ্যে যারা পৌঁছোতে চেয়েছে (ব্রিটো ১৯৮৬, এবেল ১৯৯৮, দাশগুপ্ত ১৯৯৩, ২০১১, ২০১২ক, খ) তাদের মনে হয়েছে, দ্বিসংকেতনের প্রথম পরিস্ফুটন বড়ই বেশি একাগ্রচিত্তে সংহিতানির্ভর ব্যাকরণ-অভিধান-সর্বস্ব ডবল গ্রন্থনের গল্প ফেঁদেছিল। পূর্বসূরিদের নির্মিত ওই ‘আকরণবাদী’ দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের আস্থা নেই। বয়ানে বয়ানে সম্পর্ক আর কথাবার্তার মৌখিক স্রোতের জটিলতা বিষয়ে সচেতন বাচকীয় পরিস্ফুটনের দিকে যাওয়ার পথ খুঁজছে তারা। এই অন্বেষণের একটা নাম ‘কায়াবাদ’। এক ভাষার দুই শাখার স্বাতন্ত্র্য মেনে নিয়ে তাদের মধ্যে চুক্তির কথা ভাবতে ঠিক কেন আমরা নারাজ সে-প্রশ্নের উত্তরে কায়াবাদীরা বলে ওঠে, হঠাৎ শাখাভাষা বলতে যাব কেন, আমরা কি শাখামৃগ? আমরা ভাষাই বলি, সেই ভাষার ভিতরে কিছু আনাচ-কানাচের গল্প থাকলে থাকুক, তাই বলে প্রত্যেকটা কানাচকে আলাদা ভাষাপরিচিতির দাবিতে জেহাদ ঘোষণা করতে উসকে দেওয়া রাজনীতিতেও অসমীচীন, ভাষ্য রচনার কৌশল হিসেবেও অনুপযোগী। কায়াবাদীর চোখে দ্বিসংকেতন একটা গতিশীল প্রক্রিয়া। বাচকীয়তার বিভিন্ন পরতের মধ্যে সম্পর্কের রংবদল সামলে চলার ব্যাপার। এর জ্যামিতি ধরতে পারার জন্যে সমতলটাই যে ঢেউ খেলানো সেদিকে নজর দেওয়া দরকার, কোথাও পাহাড় কোথাও খাদ আছে ধরে না নিয়ে। পাহাড় চড়ার কথা হচ্ছে না, একটু উঁচু-নিচু জমিতে ঠিকমতো হাঁটতে শেখার ব্যাপার।
   বঙ্কিমচন্দ্রে পৌঁছোবার আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে বাংলায় সাধু উঁচুর সঙ্গে চলিত নিচু মিলিয়ে এবড়ো-খেবড়ো মাটিতে হাঁটতে হয় লেখককে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্যকে এই ধরনের আতসকাচের নিচে ধরলে দেখা যায়, একই রচনায় তিনিও প্রয়োজনে সাধুর সঙ্গে চলিত ক্রিয়াপদ-সর্বনাম মিশিয়েছেন (দাশগুপ্ত ১৯৭৮)। ঠিক কেন এ-কাজ করেছেন সে-প্রশ্নের জবাব দিতে বর্গপ্রথা বা জেনেরিক কনভেনশনের ডাক পড়ে। বিদ্যাসাগরের গদ্যভঙ্গি চয়নের সেই বিশ্লেষণে একটু রদবদল করে নিয়ে কি আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের কথাসাহিত্যে দ্বিসংকেতনের কিছু সূত্র খুঁজে পাব না? বাঙালিদের বাচকতার উঁচুনিচু কীভাবে বাংলা গদ্যে বিধৃত রয়েছে তার গোড়ার কথা ওইরকম সরঞ্জামের সাহায্যে স্পষ্ট করে নিয়ে তার ভিত্তিতে কি আমরা বাংলা গদ্যে আধুনিক অর্থে রাজনৈতিক শব্দের উন্মেষের একটা কাজ চালানো ছবি আঁকতে পারি না? সেসব করে তবেই না আজকাল এই যে নেশনকে ইম্যাজিন করা টরার বাগভঙ্গি চালু হয়েছে সেইসব হালনাগাদ কথাবার্তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছোনো যাবে। নইলে আলটপকা গণতন্ত্রকে ধরে বেঁধে মারতে মারতে নিয়ে আসছি কোন সুবাদে আমাদের এই আলোচনায়?
   এভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করার কথা যে তুলছি তার কারণ, যেসব পাঠক ধরেই নিয়েছেন যে বঙ্কিমচন্দ্র মানেই জাতীয়তাবাদ তাঁদের মাথায় এই ধরনের জিজ্ঞাসা যে ঘোরাফেরা না করে পারে না সেটা তো আমি জানি। কথাটার পাশ কাটাবার চেষ্টা করে কী লাভ। সামনাসামনি মোকাবিলা করাই ভাল। এই জাতীয়তাবাদী অনুধাবনের জন্যে তো বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও দায়ী। শুধু তো বন্দে মাতরম্ই লেখেননি; বয়ানের পর বয়ানে স্পষ্ট করেছিলেন দেশের প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তির ধারা তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে প্রবাহিত। তাই বঙ্কিম রচনাবলির জাতীয়তাবাদী পাঠের সমান্তরাল পঠনান্তরের সন্ধানে বৃথা কালক্ষেপ না করে বরঞ্চ এইদিকেই নজর দিলে পারি যে, পরবর্তী প্রজন্মে দ্বিসংকেতন নিয়ে প্রমথ চৌধুরী আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন মেতে উঠলেন, তাঁরা যখন দাবি করলেন যে সাধু বাংলা রচনারীতির সঙ্গে জনসাধারণের মুখের ভাষার দূরত্ব না ঘোচাতে পারলে দেশের লোকের কোনো উন্নতি হবে না, সেই সময়ে পরিষ্কার দেখা গেল যে বাংলা ভাষা থেকে দুর্গম ‘সাধু’ সংকেতনকে হটাতে তাঁরা যে চাইছেন সেটা জাতীয়তাবাদী কার্যক্রমেরই পরবর্তী ধাপে, গণতন্ত্রমুখী পর্বে, পৌঁছোবেন বলেই। অর্থাৎ আমি এখানে বাংলা গদ্য নিয়ে যেভাবে কথা বলতে চাইছি তার প্রস্তুতিপর্বে শুধু যে বহু দিন ধরে অনেক সমালোচকের চেষ্টায় সযত্নে অঙ্কিত বঙ্কিমচিত্রটাকেই দেওয়াল থেকে টেনে নামাতে বলছি তাই নয়, এমনকি সাধু বাংলার পতন আর চলিত বাংলার উত্থানের সুপরিচিত কাহিনিটাকেও পুনর্বিচার করতে বলছি। এটা কি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না?
   হচ্ছে কিনা সে বিচার অবশ্যই বিশেষজ্ঞ পাঠকদের; আমি তো বঙ্কিমবিশেষজ্ঞ তো নই বটেই, এমনকি পেশাদার সাহিত্যসমালোচকও নই। সুধীবৃন্দের বিবেচনার্থে নিবেদন করছি, গণতন্ত্রের ইতিহাসের কিছু সূত্রই এই প্রবন্ধে আমার অন্বিষ্ট। লেখক হিসেবে বঙ্কিম গণতন্ত্রের বাচকীয় পরিসর এমন যুগে প্রতিষ্ঠা করছিলেন যে যুগে চলার বেগে তাঁর পায়ের নিচে যে রাস্তা জেগে উঠছে সে পথের মানচিত্র আঁকতে কেউই জানত না – না ভারতে, না পশ্চিমে। একথা আমার কেন মনে হচ্ছে? সর্বজনবিদিত কারণে।
বঙ্কিমবিশারদেরা আমার চেয়ে অনেক ভাল জানেন যে তাঁর প্রথম উপন্যাস তিনি বাংলায় লেখেননি, লিখেছিলেন ইংরেজিতে (চ্যাটার্জি ১৮৬৪/১৯৯৬)। কিন্তু রাজমোহন’স ওয়াইফ-এর প্রতি লেখকের কোনো মমতা ছিল না। ইংরেজিতে আর কখনও গল্প লেখেননি। বাংলায় নিজের ঔপন্যাসিক জীবনের সূচনায় বঙ্কিম লোকজন ডেকে দুর্গেশনন্দিনী পড়ে শোনান। তাঁর এই মনোযোগ্য সিদ্ধান্তের পাশাপাশি তাঁর স্বভাষীদের ভাষায় সাহিত্যরচনার সিদ্ধান্তটাকে বসালে দেখতে পাই, সাহিত্যচর্চার প্রকল্পের সঙ্গে তিনি আটপৌরে কথোপকথনের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। যা বলছি সেটা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগতে পারে, কারণ আজকাল পাঠকেরা ধরেই নেন যে তাই তো হবার কথা; কিন্তু রাজমোহন’স ওয়াইফ পড়লেই দেখা যায়, বিশ্লেষণ আর প্রতিকৃতনের চালচিত্রের দিক থেকে ইংরেজ সাহিত্যিকদের কর্মকাণ্ডে বঙ্কিম যোগদান করতে জানতেন, এবং দেখতে পেয়েছিলেন যে ওই কাজে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিলে তাঁর নিজের দেশের আটপৌরে কথাবার্তার আবহ থেকে কেটে বেরিয়ে গিয়ে তাঁকে ইংলণ্ডের পাঠকের দরবারে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, তারা তাঁর বিশ্লেষণের তারিফ করবে এই আশায়।
কথাটা খালি আমারই মনে হয়েছে এমন নয়। রাজমোহন’স ওয়াইফ-এর মুখবন্ধে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ও লিখেছেন, “When Bankimchandra, who was in the first graduating batch of the newly-founded Calcutta University, began to write Rajmohan’s Wife, he must have known that the English-reading population of Bengal was not very widespread. Did he visualize very clearly who was going to be his reader? The half-hearted attempts at textual explanations of cultural details indicate a vague awareness of readers who may be outsiders to the Bengali way of life – possibly the British administrators in India – but given the historical circumstances and the place of publication, this could not have comprised a sizeable readership. His subsequent decision of never again writing fiction in English may have had as much to do with his realization of the illusory nature of his audience as with his nationalist ideology, or his honest artistic self-appraisal” (Chatterjee 1996: vii).
অলঘু কথোপকথনের সূত্রপাত করাই যে বঙ্কিমচন্দ্রের সংকল্প ছিল সেটা স্পষ্ট হয় যখন লক্ষ করি, তাঁর প্রথম উপন্যাসে তিনি – ইংরেজিতে লিখলেও – সমকালীন বঙ্গদেশে মহিলাদের অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। মীনাক্ষী তাঁর মুখবন্ধে বলেন,Rajmohan’s Wife is very nearly realistic in its representation of East Bengal middle-class life. The story of the beautiful and passionate Matangini married to a villainous man is astonishingly rich in vivid details in the description of interiors and the quotidian routine of women’s lives. […] There is also an attempt […] to foreground the ways in which the home and the world are inextricably linked […] by locating the drama within the conjugal and domestic space in relation to the external arena of property, legality, crime and the colonial administration. Inscribed in the text we also find an early statement about the helplessness and claustrophobia of women in incompatible marriages that was going to be a recurrent concern of Indian fiction for many years to come. Given the rigidness of the power structure within the family among upper-caste Bengalis in the nineteenth century, it seems surprising that the first Indian novel in a contemporary setting should have focused on a woman of uncommon vitality who refused to be completely subjugated either by her brutal husband or by the expectations of society” (Chatterjee 1996: vi-vii).
আশা করি বিবেচক সুধীবৃন্দ দেখতে পাচ্ছেন যে বঙ্কিমের আদ্যন্ত জাতীয়তাবাদ-সর্বস্ব পঠনরীতির সঙ্গে সূচনামুহূর্তের এই খুঁটিনাটিগুলো খাপ খায় না।
বঙ্কিমচন্দ্রের ওই সময়কার সিদ্ধান্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের মনে পড়ে গ্রীক পুরাণের একটা গল্পের কথা। মেদুসা নাম্নী রাক্ষসীকে মারবেন বলে অঙ্গীকারবদ্ধ বীর পেরসেউস জানতেন কোনো মানুষ ওই রাক্ষসীর দিকে তাকালেই পাষাণ হয়ে যাবে। তিনি তাই নিজের ঢালটাকে আয়নার মতো ব্যবহার করে সেই আয়নায় মেদুসার অবস্থান দেখতে দেখতে মেদুসা-বধ করেন। একইভাবে বঙ্কিম জানতেন, উনিশ শতকে ভারতের ইংরেজ শাসকদের যে নৈতিক আর সারস্বত কর্তৃত্ব সেটার চোখে চোখ রেখে লিখতে গেলে শুধু যে চোখ রাঙানির সমস্যা বা সেনসরের কাঁচির ভয় তাই তো নয়, গদ্যের নান্দনিক আর বাচকীয় সম্ভব-অসম্ভবের জ্যামিতির জায়গাতেই ওরকম প্রকল্প সূত্রপাতের আগেই আটকে যায়। ওরকম যুগে সারস্বত ক্ষমতার বাস্তবের সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামবার কোনো মানে যে হয় না সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট ছিল সকলের কাছে। কী করার মানে হয় সেটা বঙ্কিমচন্দ্রই দেখতে পেয়েছিলেন।
আশু কর্তব্য যে পাঠক তৈরি করা সেকথা তিনি একাই বুঝতে পেরেছিলেন। যথাসময়ে সেই পাঠকসমবায় গণতন্ত্র আদায় করে নেবে – সে-প্রক্রিয়ার প্রথম পর্বে বিদেশি শাসকদের হটিয়ে দিয়ে। এও দেখতে পেয়েছিলেন যে এই সমবায় নির্মাণ প্রকল্পের একটা জরুরি দিক হল পাঠিকা তৈরি করা। অর্থাৎ কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত পুরুষ পাঠকদের রাজি করাতে হবে যাতে পাঠিকা তৈরির কাজে তাদের সানন্দ সরস সহযোগিতা পাওয়া যায়। এইভাবে যদি আমরা বঙ্কিমের সামগ্রিক প্রকল্পটাকে অনুধাবন করি, তাহলে তাঁকে একইসঙ্গে অনেকগুলো দিক সামলে চলতে হচ্ছে বলে রচনায় বিভিন্ন উপাদান কী কী কাজ করছে সেবিষয়ে এমনসব প্রশ্ন জেগে ওঠে যার ভাষ্য প্রাচীন বা নবীন কোনো রসশাস্ত্রের দরবারেই নেই।
মেদুসা-বধের সময় পেরসেউসের সম্বল তাঁর ঢালদর্পণ। বঙ্কিম যখন উনিশ শতকের বুদ্ধিজগদীশ্বরের সঙ্গে লড়াইয়ে নামছেন তখন তাঁর কলাকৌশলে সে-শত্রুর প্রতিবিম্ব ধরা দেয় আয়নার ভিতরের আয়নায়। তাঁর আখ্যানে ভারতীয় ইতিহাসের এক প্রাকব্রিটিশ যুগের রঙ্গমঞ্চে রাজনৈতিক দক্ষতাসম্পন্ন সক্রিয় নায়কচরিত্র ফুটে ওঠে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন নায়িকার সতৃষ্ণ বরণ আর সজাগ অনুধাবনের রসায়নে।
এই সজাগ বরণ যে-নায়কদের বঙ্কিমের পাঠকের চোখে বিশ্বাস্য করে তোলে তাদের অনুরূপ মানুষ ভবিষ্যতে ইংরেজদের সঙ্গে সত্যিসত্যিই লড়তে পারবে এমন স্বপ্ন এভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। পাঠক মনে মনে দেখতে পান, তাঁরই অনুরূপ পাঠকেরা এক দিন এক ব্যাপক শক্তিশালী সমাজের রূপ ধারণ করবে; সেই সমবায়ের কোলে জন্মে ওইরকম অনেক নায়ক পরাধীনতার কারার লৌহকপাট ভেঙে দিয়ে গণতান্ত্রিক বিকল্প প্রতিষ্ঠা করবে। এখানে ‘গণতন্ত্র’ বলতে বোঝায় পরিণতবুদ্ধি এমন চিন্তাশীল মানুষের নেতৃত্ব যাঁরা সমালোচনাশিল্পে নিপুণ সহনাগরিকদের সমস্ত কথার জবাব দিতে রাজি থাকেন, সমবায়ের নৈতিক আর নান্দনিক রুচির মর্যাদা রক্ষা করে; লক্ষ করা জরুরি যে সেই রুচির সবচেয়ে মূর্ত বাহন হল অনুধাবনশীল মহিলাদের নিভৃত বা অর্ধপ্রকাশ্য কথাবার্তা। বঙ্কিমকে আমি যেভাবে পড়ার প্রস্তাব করছি তার ছবিটা তাহলে বৃত্তের ভিতরে বৃত্তানুবৃত্তের অন্তরঙ্গ জ্যামিতি ফুটিয়ে তোলে। এই ধরনের জ্যামিতিই যে বঙ্কিমের উদ্দিষ্ট ছিল এটুকুই বলতে চাইছি; তিনি এই ছবির প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি আলাদা করে চেয়েছিলেন এমন অবাস্তব প্রস্তাব করতে যাব কেন।
আমার প্রস্তাব তা সত্ত্বেও যে-পাঠকের চোখে অবাস্তব ঠেকবে তিনি স্বভাবতই জানতে চাইবেন, এ-বক্তব্যের ভিত্তি কোথায়। এর জবাবে বলব, বঙ্কিমের উপন্যাসসমগ্রে মহিলাদের নিভৃত কথাবার্তার স্থান মন দিয়ে লক্ষ করলেই ধরতে পারবেন কী বলছি এবং কেন। তিনি যখন যখন স্ত্রীচরিত্রদের কথোপকথন দেখান প্রত্যেক বারই বাংলার দ্বিসংকেতন-খচিত ঐশ্বর্যের সবটাই কাজে লাগান। উদাহরণত দুর্গেশনন্দিনীতে তিনি যা করেছেন সেই কৃতিত্বের সামান্যতম চিত্রণও যাতে অশিথিল ভাষ্যের সাধ্যে কুলোয় সেজন্যে ভাষা নিয়ে যে-ভাবনায় আমরা অভ্যস্ত তার কিছু কিছু সূত্রের পুনর্বিবেচনা হওয়া দরকার। যা লাগবে সেটা হল লিখিত বয়ানের সঙ্গে মৌখিক কথাবার্তার সম্পর্কের নতুন পরিস্ফুটন।
প্রয়োজনটা এত বড় মাপের অথচ এমন চরম অবহেলার শিকার যে এ-পুনর্বিবেচনার কাজ ভাষাতত্ত্বের একার সাধ্যে কুলোবে না। সর্বসাধারণই ভাষাভবনের স্থপতি। ভাষাতাত্ত্বিকেরা জলের কল বসিয়ে দেওয়ার মতো দুচারটে মিস্ত্রিগিরি করে দেয়, ভবনের চেহারা তারা কী করে পালটে দেবে? সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা তো এইজন্যেই।

0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]

<< Home