Monday, March 18, 2013

Jabaan-jominer aabaad


[‘ভাষা, সাহিত্য ও সমাজ: পরিবর্তন, সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় চর্চাসত্রের প্রস্তাবনা-ভাষণ, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, শিলচর, ১২-১৩.৩.২০১৩]

সারসংক্ষেপ

বেশ কিছু ভাষার বিপন্নতা নিয়ে মনীষীরা সম্যক উদ্‌বিগ্ন। সেইসব ভাষার জমিতে আবাদ করলে সোনা ফলবে বলে তাঁদের বিশ্বাস। এধরনের বিশ্বাসে অথবা উদ্‌বেগে সায় দেবার আগে একটু ভেবে দেখা দরকার। যে-মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে এইসব ভাষার আসন্ন পতনের ভয়ে তাঁরা ভীত, সেটার অঙ্কনভঙ্গিতে ধরেই নেওয়া আছে যে সর্বাধিক সফল ভাষা ইংরিজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজলি সড়ক পানি ভিত্তিক আধুনিকমন্য উন্নয়নের ধাঁচটাই বুঝি সর্বজনস্বীকার্য। মানচিত্রপ্রণেতারা ধরেই নিতে বলেন যে অন্যান্য ভাষার বেলাতেও সাফল্যের জ্যামিতি একইরকম দেখাবে। কিন্তু সমৃদ্ধির বিকল্প পথের সন্ধান পেলে, জল জঙ্গল জমিনের দিকে মন দিতে শিখলে, বিপদের আসল উৎস যে ধরতাই বুলিতে গা ভাসিয়ে দেওয়া তথাকথিত মূলস্রোত, তার চোখে চোখ রেখে আমরা সত্যিই বর্তমান সংকটের কল্পনা পার হয়ে এগিয়ে যেতে পারব। যে দ্বিসংকেতনে ইংরিজির সিংহাসন নির্মিত, তারই পাদপ্রদীপের জায়গাটাকে উজ্জ্বলতার প্রকৃত অকুস্থল বলে চিনতে শিখব। পুনর্বিবেচনাপ্রসূত নতুন দৃষ্টি অর্জন করে সমস্যার এবং সমাধানের জায়গা খুঁজে নিতে পারব যুক্তিগ্রাহ্য মানচিত্রে।


।।উ প ক্র ম ণি কা।।

    অনেকের জানা গানের কলি থেকেই শুরু করি: ‘মন রে, কৃষিকাজ জানো না/ এমন মানব-জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা’। কেউ কেউ মনে করেন, ভাষার শ্রীবৃদ্ধি নির্ভর করে ভাষা-পরিকল্পনা বলে একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার উপর। সে-কাজের অন্যতম উপাদান হিসেবে তাঁরা তুলে ধরেন ‘ভাষা-পরিশীলন’ বলে একটা উপপ্রক্রিয়াকে। এর ইংরিজি নাম রেখেছেন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ কালটিভেশন’। শুনে খালি-যে চাষবাসের কথাই মনে পড়ে তাই নয়। আবাদ যেখানে হবে সে-জায়গাটাকে জমি বলে ভাববার ঝোঁককেও প্রশ্রয় দেওয়া হয় এই বাচনভঙ্গিতে। জমিটা তখন লড়াইয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সে-লড়াইয়ের অস্ত্র নতুন নতুন পরিভাষা সৃষ্টি, সেইসব শব্দ চালু করবার জন্যে বিশারদদের দিয়ে বইপত্র লেখানো – এবং আজকের দিনে সচিত্র এবং/অথবা সবাক বৈদ্যুতিন দলিল প্রণয়ন করানো – তারপর জনগণের মনের সরোবরে সেইসমস্ত মাছ ছেড়ে দেওয়া যাতে তারা ডিম পাড়ে। এভাবে নাকি শত্রুকে কাত করা যাবে। সেই শত্রু নাকি বৃহত্তর ভাষার, যেমন ইংরিজি বা হিন্দি বা অসমিয়া বা বাংলার, শব্দের অনুপ্রবেশ। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া আর সেই বেড়ার সশস্ত্র পাহারাওয়ালা রাখলেই বুঁদির কেল্লা সুরক্ষিত থাকবে সারাক্ষণ। কেউ কেউ এইরকম একটা গল্প বলে চলেছেন অনেক দিন ধরে। এবং গল্পটা লোকে যাতে বিশ্বাস করে সেজন্যে যথাসাধ্য গেল গেল ধর্ ধর্ রব তুলে লোকজনের মনে উদ্‌বেগ বাড়িয়ে তুলেছেন।
    বিপদ আছে সেকথা সত্যি। কিন্তু ত্রস্ত হলে সে-বিপদ ঠেকানো যাবে না। বিপন্ন ভাষা নিয়ে আলোচনার সূত্রে কাণ্ডারিরা চেষ্টা করেন ছোটো ছোটো ভাষার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে। তারপর কায়দা করে আলোচনার ধারা নিয়ে আসেন এমন নীতির দিকে যাতে লোকে সায় দিয়ে কাণ্ডারিদের হাতে যেসব অস্ত্রশস্ত্র আছে সেগুলো প্রয়োগ করার পক্ষে ভোট দিয়ে ফেলেন। আমার প্রধান বক্তব্য এই: ওই কাণ্ডারিদের মতলব লক্ষ করে যদি আপনারা তাঁদের অভিসন্ধি ভণ্ডুল করতে একটুও চান, তাহলে আপনাদের অন্যতম কর্তব্য হল ওঁরা যেদিকে নজর দিতে বারণ করছেন সেদিকেও তাকানো। অর্থাৎ, তথাকথিত সফল ভাষাগুলোর ওই বহু বিজ্ঞাপিত সাফল্যের দিকেও নজর দেওয়া। যেমন ইংরিজি। শুধু ইংরিজি কেন? মানছি, অন্যদের দাপটের দিকেও তাকানো নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু এক নিঃশ্বাসে ইংরিজি হিন্দি বাংলা অসমিয়ার কথা বলতে গেলে সমস্ত তালগোল পাকিয়েও যাবে, আমার মতো কোনো একজন কর্মীর বিদ্যেতেও কুলোবে না। বিশেষ বিশেষ দাপটের ভুক্তভোগীরা আজ না হোক কাল সেই সেই গল্প তুলে ধরবেন বলে ভরসা রাখি।
    দক্ষিণ এশিয়ায় যেভাবে ব্রিটিশ শাসনের দরুন ইংরিজি এসেছিল, সেভাবেই নানাবিধ ঔপনিবেশিক শাসকের হাত ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে ডাচ, ফরাসি, পোর্তুগিজ, স্প্যানিশ, এমনকি ইটালিয়ান এসেছিল। সেসব ভাষার দায়ভাগের সঙ্গে মোকাবিলা করার কাজ আজও শেষ হয়নি এশিয়ায়, আফ্রিকায়, আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়। অধিকন্তু আদিবাসীদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে আমরা যারা অনাদিবাসী তাদের চাপিয়ে দেওয়া ভাষাগুলোর উদ্‌বৃত্ত দাপটের মানচিত্র আঁকা; এবং সহজবোধ্য বিরূপতা সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গে বসেই ঠিক করা, কীভাবে আমাদের দীর্ঘকালীন অত্যাচারের কুফল কাটিয়ে উঠে তাঁরা এমনভাবে দেশের সমস্ত নাগরিকের সঙ্গে ঘর করতে পারবেন যাতে একদিকে তাঁদের আদিবাসী মাতৃভাষাসমূহের শ্রীবৃদ্ধিও হয়, আবার অন্যদিকে এই প্রক্রিয়ার ফলে কোনো এলাকা-বিশেষে সীমাবদ্ধ ভাষার শিক্ষাদীক্ষায় আটকে গিয়ে তাঁরা দেশের সর্বত্র অবাধে ঘুরবার ফিরবার কিংবা বাসা বাঁধবার অধিকার হারিয়েও না ফেলেন।
    চোখে আঙুল দিয়ে ফরাসি পোর্তুগিজের কথা বলবার দরকার হত না যদি ভারতে সকলেরই জানা থাকত যে আফ্রিকায় ফরাসিদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে সকলেই আজও লেখাপড়া থেকে শুরু করে প্রশাসনাদি সবই ফরাসিতে করে থাকে। আফ্রিকানদের নিজস্ব প্রস্তাবের দৌলতে ছোটো ছোটো খেলনা সিংহাসনে যেসব সোয়াহিলি-টোয়াহিলিকে বসানো হয়েছিল সেসমস্ত বিস্তৃত-অথচ-আঞ্চলিক ভাষা যাতে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকে তার জন্যে সমাজের অনেক মহল উঠে পড়ে লেগেছিল। তারা যা চেয়েছিল আপাতত সেটা পেয়েও গেছে, চিন্তাশীলদের আলস্যের ফলে। তাই ব্যাপক লড়াইটা স্রেফ ইংরিজির সঙ্গে পেরে ওঠার ব্যাপার নয়; সমস্ত প্রাক্তন ঔপনিবেশিক ভাষার দাপটের সযত্ন ইতিহাসমনস্ক মানচিত্র আঁকতে আঁকতে এগোতে হবে আমাদের। জমির লড়াইয়ের শস্তা জনবাদী স্লোগানে নিজেদের আটকে যেতে দেওয়া-যে আসলে রণে ভঙ্গ দেওয়ারই নামান্তর, এই সত্যটা আমরা অনেকে দেখতে পাচ্ছি না বলেই আমাদের এতটা শক্তিক্ষয় আর সময় নষ্ট হচ্ছে।
    জবান-জমিন রইল পতিত? আবাদ করলে ফলত সোনা? এই সুরে যে-লোক গান ধরতে রাজি সে কি বুঝতে পেরেছে কোনটা সোনা, কোনটা রুপো, কোনটা তামা? সদাগরপুত্রকে রাজপুত্র ভেবে সিংহাসনে বসিয়ে দেয়নি তো?
    উন্নয়নের সামগ্রিক ধারণার হাত ধরেই ভাষা-পরিকল্পনার ভাষ্য উঠে এসেছে। বিজলি-সড়ক-পানি যে-আদলের মন্ত্র, তার বিকল্প হিসেবে আজকাল কোনো কোনো মহলে অবশেষে জল-জঙ্গল-জমিনের নতুন আহ্বান খানিকটা গ্রাহ্যতা পেতে শুরু করেছে। আমি-যে সেই বিকল্পের হয়েই ভাষ্য নির্মাণ করার চেষ্টা করছি সেকথা খোলাখুলি জানিয়ে কাজ শুরু করছি এখানে। কাজটা চট করে হবে না। সেজন্যে লক্ষ্যসচেতনতা অর্জন করার দিকে মন দেওয়া দরকার গোড়াতেই। এক কথায় বলতে পারি, আমার লক্ষ্য হল বড়োলোক ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয়ধন্য বিজলি সড়ক পানিতে যে-সড়কের জয়গান রয়েছে তার পাশ দিয়ে মানুষের পথ চলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ধীরগতি সমঝদার লড়াইটাকে ভারতীয় গণতন্ত্রে এমন স্থায়ী কাজের জায়গা হিসেবে বসানো যে বণিকেরা আমাদের সঙ্গে লাগতে আসবার আগে সাত বার ভাববে। এ-কাজ শুরু করতে পারার প্রথম ধাপ হল, পোশাকি কথাবার্তার যে-জায়গাটা ওরা চুপিচুপি কবজা করে নিয়েছে সেইটাকে আবার দখল করা। তাই কিছু কিছু লেখাপড়ার প্রসঙ্গের অবতারণা – যে-লেখাপড়ার এলাকাটা ব্যবসায়ীর দল আর তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা, খোলাখুলিই বলছি, ছেঁদো বইয়ের পর ছেঁদো বই লিখে ভাসিয়ে দিয়েছে।
    যাঁরা না বুঝে ব্যবসায়ীদের অর্ধসত্যগুলোতে সায় দিয়ে ফেলেছেন তাঁরা অনেকে ভেবে মরেন, যেসব ভাষা অপাঙক্তেয় হয়ে রইল কিংবা সাবেক কালের পাঙক্তেয়তা হারাতে বসেছে, তাদের কী হবে। ওভাবে ক্ষয়ের আর ব্যর্থতার কথা ভেবে যাঁরা বিলাপ করছেন অথবা প্রতিকার চাইছেন তাঁরা অনেকেই ধরে নিয়েছেন, পরম সার্থক ভাষা হিসেবে ইংরিজির উত্থানের কষ্টিপাথরে বিচার করাই এযুগের সকল বিশ্লেষণকারীর কর্তব্য। এই ধরে নেওয়াটাকে বিচার করতে চাইলে ইংরিজির ওই ঘোষিত সাফল্যের দিকে মন দিয়ে তাকানো জরুরি। অনেকেই সে-কাজ করে ওঠার সময় পাননি। এ-বিষয়ে আমি কিছু দিন ধরে যা নাড়াচাড়া করছি তার কিছু ফসল নিবেদন করতে চাইছি তাঁদের কাছে যাঁরা ‘আবাদ আবাদ’ বলে এইরকম জমিবাজি করতে ব্যস্ত। তারপর তাঁদের সঙ্গে বসে ভাবতে হবে। মানব-জমিন কাকে বলে? আবাদ কাকে বলে? ভিটেমাটির প্রশ্ন সেখানে লোকের তাৎক্ষণিক আবেগের জায়গাটাতে যেভাবে জড়িয়ে গেছে সেই উপস্থাপনটাতে সায় দেওয়া কি চিন্তাশীল কর্মীর পক্ষে ঠিক কাজ? পুনর্বিবেচনা করলে মানচিত্র কীরকম পালটে যায়? তখন কর্তব্য আর অকর্তব্য কেমন দেখায়? ইত্যাদি। সবটাই-যে এক পশলা আলোচনায় মীমাংসিত হবার নয় সে-কথা নিশ্চয় বলাই বাহুল্য। আশা করব আমার এই বক্তব্য খণ্ডন করার জন্যে বিপক্ষের কর্মীরা এগিয়ে আসবেন। যে-পাঠকেরা নিরপেক্ষ, তাঁরা আশা করি নজর রাখবেন বিপক্ষ এবার আমার বক্তব্যের জবাব দিচ্ছে, না যথারীতি পালিয়ে বেড়াচ্ছে।


ভারতে ইংরিজির বিখ্যাত জয়যাত্রা

ভারতে ইংরিজির সত্যিসত্যিই কীরকম অবস্থিতি, এ-প্রশ্নের ভাষাতাত্ত্বিক সরঞ্জাম বিদ্ধ জবাব দিতে বসলেই দ্বিসংকেতনের প্রসঙ্গ তুলতে হয়। প্রথমে তাই সংকেতন আর দ্বিসংকেতনের কিছু বুনিয়াদি সূত্র পেশ করলে পারি। মোটা দাগের সংজ্ঞার্থ হাতে পেলেই চলবে আপাতত।

বাক্যালাপ করতে গিয়ে তুমি যেসব কথা উচ্চারণ করছ – যেমন গাছ, পাখি, পুরুষ, মহিলা, পেড়, চিড়িয়া, আদমী, অওরত, ট্রি, ব্যর্ড, ম্যান, উওম্যন – সেগুলো সংকেতক বা সিগ্নিফায়ার। কাগজে আমি পর পর কয়েকটা অক্ষর বসিয়ে দিয়ে তোমার উচ্চারিত সংকেতক দেখিয়ে দিতে পারি। কিন্তু সেইসব আধার যার বাহন সেই আধেয় বা মানেগুলোকে ওভাবে চোখের সামনে আনতে পারি না।

একেকটা সংকেতক যে-ওজন বইছে সে-মানেটাকে বলা হয় তার সংকেতিত কিংবা সিগ্নিফাইড। কাগজে সংকেতিত বোঝাতে চাইলে কেউ কেউ বিশেষ কিছু একটা আঁকিবুকি কাটে। আমি বাংলায় এ-কাজ করতে বসে সচরাচর সংকেতকের ডানদিকে খণ্ড ‘ৎ’ বসিয়ে দিই। যেমন ‘পাখি’ সংকেতকটার যে-সংকেতিত, সেটা বোঝাবার জন্যে ‘পাখিৎ’ লিখি। সংকেতক আর সংকেতিত, এ-দুয়ে মিলে যে-পদার্থ, তাকে বলে সংকেত অর্থাৎ সাইন।

ভাষাতাত্ত্বিকের চোখে সংকেতের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার আপতিকতা। কোনো সংকেতকের সঙ্গে তার সংকেতিতের কোনো প্রকৃতিনির্দিষ্ট সম্পর্ক নেই। কথাটা আরেকভাবে বলতে পারি: স্বাভাবিক সংকেত বলে কিছু হয় না। কল্পনা করুন আপনি আমি এমন কোনো আজগুবি জগতে বাস করছি যেখানে ‘গাছৎ’ আধেয়টা প্রকাশ করতে চাইলেই সব মানুষেরই ‘গাছ’ বলতে ইচ্ছে করে, কেউ কখনও ট্রি কিংবা পেড় বলে না। সেই কাল্পনিক দুনিয়ায় ভাষাবৈচিত্র্যের কথা বলাই যেত না, কারণ ভাষায় ভাষায় কোনো হেরফের থাকত না। এমনকি আমরা সে-দুনিয়ায় ‘সমস্ত মানুষ বাংলা বলে’ এরকম বক্তব্য অবদিও পৌঁছতে পারতাম না। কারণ, ‘বাংলা’ বলে আলাদা কোনো ধারণা তৈরিই হত না আমাদের। যে-পৃথিবীতে ইংরিজি বা হিন্দি নেই সেখানে বিশেষ করে ‘বাংলা আছে’ এ-কথাটা আদপে বোধগম্যই হত না। কিন্তু আপনি তো জানেন, যে-বাস্তব জগতের আমরা সত্যিই বাসিন্দা সেখানে বাংলা ভাষার সংকেতিত ‘গাছৎ’, হিন্দির সংকেতিত ‘পেড়ৎ’ আর ইংরিজির সংকেতিত ‘ট্রিৎ’ এই তিনখানা জিনিস আধেয়গত বিচারে একই। অথচ তাদের আধারের উচ্চারণ তিন রকম, ‘গাছ, পেড়, ট্রি’। ভাষায় ভাষায় যে-তফাত সে-জায়গাটাকেই বলে ভাষার আপতিকতা।

বাংলা, হিন্দি, ইংরিজি – এরকম কোনো একটা বিশেষ ভাষার মঞ্চে নেমেই সংকেতক তার সংকেতিতকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন খেল দেখায়। সে-মঞ্চকে আমরা ভাষাতত্ত্বের পরিভাষায় বলি সংকেতন। গাছ, পাখি, পুরুষ, মহিলা এ-চারটে সংকেত তাহলে সেই সংকেতনের মঞ্চে অবতীর্ণ যার নাম ‘বাংলা’।

এটুকু বলা যদি যথেষ্ট হত তাহলে অবশ্য এই প্রবন্ধের কোনো প্রয়োজন থাকত না।

কোনো কোনো ভাষা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে শিক্ষিত মানুষেরা সে-ভাষায় দুভাবে কথা বলতে পারে। একটা ধরন সোজাসাপ্টা। বাচ্চারা কিংবা যেসব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লেখাপড়া শেখেননি তাঁরা সব সময় সেই ধরনটাতেই কথা বলেন। তাঁদের সঙ্গে যখন শিক্ষিতরা সুগম রীতিতে কথাবার্তা বলেন তখন সেসব কথা শিশুরা আর নিরক্ষরেরা বুঝতেও পারেন। কিন্তু সেই একই ভাষার দ্বিতীয় একটা দুর্গম বাচনরীতি রয়েছে। উচ্চশিক্ষার বইপত্র শিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্কদেরই সেখানে প্রবেশাধিকার। সে-বাচনরীতিতেই লেখা হয়। কোনো কোনো ভাষায় সুগম রীতির সঙ্গে দুর্গম রীতির এই তফাতের জায়গাটা একেবারে চোখের সামনে থাকে। যেকেউ দেখতে পায়। সমাজে সবাই স্বীকৃতি দেয় ব্যাপারটাকে। সেইসব সমাজের দৌলতেই ভাষাতত্ত্বের কারবারিদের একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সুগম আর দুর্গম রীতিতে দ্বিধাবিভক্ত এ-অবস্থাটার একটা নাম রাখা – দ্বিসংকেতন বা ডাইগ্লসিয়া – এবং তার রীতিনীতি বুঝতে চেষ্টা করা।

লেখাপড়ায় দীক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়াতেই যেখানে বাচ্চা বলতে শেখে ‘আম জাম পাকলে বলি হল পরিপক্ব/ মাথার নাম মস্তক আর বুকের নাম বক্ষ’, তখন সেই সমাজ নিজে নিজেই পাকা আম, মাথা, বুকের মতো কথাকে ‘চলিত বাংলা’ আর পরিপক্ব আম্র, মস্তক, বক্ষকে ‘সাধু বাংলা’ বলে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করে দেয় সেই শিক্ষাব্যবস্থাতেই। ওই দ্বিত্বটাকে আকৃত দ্বিসংকেতন অর্থাৎ ফর্মাল ডাইগ্লসিয়া বলে শনাক্ত করতে কারুর দেরি হয় না।

এ-জিনিস খালি বাঙালিদের একচেটে নয়। আরবি, গ্রিক, তামিল, তেলুগুর মতো বেশ কিছু ভাষায় রয়েছে আকৃত দ্বিসংকেতন। কিন্তু দ্বিসংকেতনের বিশ্লেষণের ব্যাপ্তি আর গভীরতা যত বেড়েছে তত ভাষাতাত্ত্বিকরা দেখতে পেয়েছেন যে ভাষার কায়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসে আছে দ্বিসংকেতনের বীজ। হেন মানুষ নেই যাকে দ্বিসংকেতনের সঙ্গে কারবার করতে হয় না। যদি ভেবে থাকি দ্বিসংকেতনমুক্ত ভাষা আছে তাহলে ভুল ভেবেছি।

বিষয়টার সূক্ষ্মতম খুঁটিনাটিতে যাবার দরকার নেই এ-যাত্রা। এটুকু মনে রাখাই যথেষ্ট যে মধ্যযুগের ইউরোপে উচ্চ মার্গের দুর্গম বাচকতার মাধ্যম ছিল ল্যাটিন, কিন্তু সাধারণ কথাবার্তা চলত বিভিন্ন স্থানীয় ভাষায়। ওই ধরনের সমাজে দ্বিসংকেতনের সঙ্গে দ্বিভাষিক অবস্থার হাত ধরাধরি ছিল বলা চলে। মধ্যযুগের ভারতবর্ষেও অনেক দিন প্রাদেশিক ভাষাসমূহের সঙ্গে দুর্গম সংস্কৃতের একই ধরনের সহাবস্থান ছিল। পরে প্রশাসনের কাজে সংস্কৃতের জায়গায় ফারসি ভাষা চালু করা হয় বিভিন্ন ইসলামপ্রধান রাজত্বের সময়ে। এ-নাট্যশালায় ইংরেজদের প্রবেশের পর একটু একটু করে ইংরিজি জায়গা করে নেয় ভারতীয় দ্বিসংকেতন তন্ত্রের দুর্গম অঞ্চলে।

আজকের ভারতেও একথা বলা ভুল হবে যে বিশেষ কোনো এলাকার অধিবাসীরা জন্মসূত্রে ইংরিজিভাষী অর্থাৎ পেট থেকে পড়েই ইংরিজি শেখে। দুচারটে সেরকম অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান পরিবার নেই তা নয়। কিন্তু তাদের প্রায় আঙুলে গোনা যায়। ভারতে ইংরিজি যাঁরা বলেন তাঁরা প্রায় সকলেই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরিজি শিখেছেন, যদিও এঁদের অনেকেই ভাষাটা দস্তুরমতো রপ্ত করেছেন, করবেনই তো, দ্বিসংকেতনের ব্যবস্থাপনায় ইংরিজির ভূমিকা-যে তাঁদের কাছে খুবই জরুরি।

এতক্ষণ এমনভাবে কথা বলেছি যেন দ্বিসংকেতন বলতে সর্ব দেশে সর্ব কালে একেবারে একই জিনিস বোঝায়। কিন্তু প্রাচীন কালে আর মধ্যযুগে জ্ঞানমঞ্চের ক্রমবিবর্তনের দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে মধ্যযুগের ভারতবর্ষে মস্ত বড়ো একটা পালাবদল ঘটেছিল। দ্বিসংকেতনের ভরকেন্দ্র দুর্গম রীতি থেকে সুগম রীতিতে সরে আসে। সেই সুগমরীতিকেন্দ্রিক নতুন ব্যবস্থাই এখনও চলছে বলে আজকের দিনের ভারতীয়রা যে যার নিজের স্থানীয় ভাষার মাধ্যমে যে-পরিচিতি অর্জন করেছেন সেই বাঙালি গুজরাটি ওডিয়া পাঞ্জাবি নাগা খাসি মিজো অসমিয়া পরিচিতিতে স্থৈর্য রক্ষা করেও দেশের আর-সবার সঙ্গে দুর্গম ইংরিজিতেই কাজকর্ম করে থাকেন। তাতে তাঁদের পরিচিতি রক্ষায় কোনো ব্যাঘাত হয় না।

এ-বিশ্লেষণ যিনি স্বীকার করেন তিনি এও মানবেন যে ভারতের বিভিন্ন সমবায় ইংরিজিকে একরকম সিংহাসনে চড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই সিংহাসনটাকে অলংকৃত রেখেই তারা একরকম প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে রেখেছে। ইংরিজির সঙ্গে ওই দূরত্ব না রাখলে ভারতীয়দের মাথার ভেতরে ঢুকে এসে সে-ভাষার সমস্ত আদবকায়দা আমাদের সাংস্কৃতিক নিভৃতিটাকে খেয়ে ফেলতে পারত।

ইংরিজিকে সরিয়ে রাখার এই আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল উনিশ শতকেই। যা যা সাংস্কৃতিক সামগ্রী ইংরেজদের কাছ থেকে নিতে চাই সেসব এক ধার থেকে আমাদের ভাষায় অনুবাদ করে করে আমরা বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ খাটাচ্ছিলাম। ইংরিজি থেকে ভারতীয় ভাষায় উচ্চমানের প্রচুর অনুবাদ হতে থাকলে সেই সমৃদ্ধ মানসিক স্বগৃহ ছেড়ে ইংরিজি ভাষার তৈরি হোটেলে থাকার সুযোগটা ভারতীয়দের চোখে প্রলোভনের মতো দেখাবে না।

কোনো কোনো বিশ্লেষণকারীর মনে হয়েছে ভারতে ইংরিজিরও আলাদা ঘর আছে একথা বলা জরুরি। ইংরিজিভাষীরা বিশেষ কোনো এলাকায় বসবাস করে না একথা সত্যিই বটে, কিন্তু তাতে কী, আসলে ওটাও আধুনিক ভারতের একটা মাতৃভাষা, এই দেখো না, ওই ভাষায় আমাদের কোনো কোনো লেখক কীরকম উৎকৃষ্ট বই লেখে, নিজেদের ভাষা না হলে পারত কি?

কথাটা কেন আমি মানি না – কেন তার বদলে আমি ‘ইংরিজি ভারতে মাতৃভাষা নয়, মাসির ভাষা’ বলে একটা অন্য ঘরানার বক্তব্য দাঁড় করাবার চেষ্টা করে চলেছি কয়েক দশক ধরে – সেটা খুলে বলতে চাইলে ধাপে ধাপে বলা দরকার।

প্রশ্নটার দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে বিশ্লেষণ লেখার প্রথম সুযোগ পাই যখন ১৯৭৭ সালে বিশ্ব এসপেরান্তো সম্মেলনের আয়োজকদের নিমন্ত্রণে আমি রেইকইয়াভিক-এ ‘ভারতে ইংরিজির অবস্থান’ নিয়ে বক্তৃতা দিই। আন্তর্জাতিক সেতুভাষা এসপেরান্তোর বিশ্ব সম্মেলনে প্রত্যেক বছর উচ্চশিক্ষার কিছু অধিবেশন থাকে। তখন তার নাম ছিল ‘গ্রীষ্মকালীন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় বক্তৃতামালা’। সেই পর্যায়ে বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছিল আমাকে। কাজটা মনে হয়েছিল খুবই শক্ত। ঠিকই মনে হয়েছিল। ভয়ে ভয়ে আমার চেনা একজন ইতিহাসের অধ্যাপককে জিগেস করেছিলাম, ‘এ-বিষয়টা নিয়ে পড়বার মতো যা আছে সে-বই নিশ্চয়ই ভারত থেকে আনিয়ে নিতে হবে?’, সেই অধ্যাপকটি উত্তরে বললেন, ‘তোর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বোধহয় পেয়ে যাবি এরিক স্টোকস-এর লেখা “দি ইংলিশ ইউটিলিটেরিয়ান্স অ্যাণ্ড ইণ্ডিয়া”, তাতেই কাজ হয়ে যাবে’, তুইতোকারির কারণ অধ্যাপকটির নাম অরুণকুমার দাশগুপ্ত, আমার বাবা। বইটা পড়ে পেয়ে গিয়েছিলাম ভারতে ইংরিজি শিক্ষার প্রবর্তনের এক আর্থ-সামাজিক ব্যাখ্যা। সে-বিশ্লেষণের সঙ্গে এসপেরান্তো ভাষার কর্মীদের বিশিষ্ট দৃষ্টিকোণের সংযোগ স্থাপন করে ভাষার সঙ্গে ক্ষমতার মোলাকাতের জায়গাটা নিয়ে নিজস্ব ভাষ্য রচনার কাজ শুরু করে দিই ১৯৭৭এর বসন্তকালে।

ফিরে তাকালে দেখতে পাই, ওই গবেষণাতেই কায়াবাদী সমাজভাষাতত্ত্বের সূত্রপাত। কাকে বলে কায়াবাদ?

আমি তার আগের বছর বাংলা ভাষার যৌগিক ক্রিয়াপদে মেরু ক্রিয়া আর দিশারি ক্রিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ব্যাকরণের যে-বিশ্লেষণরীতি অবলম্বন করি, তার মোদ্দা কথাটা ছিল – ভেবো না যে এইখানে রক্ত থাকে, ওইখানে মাংস, সেইখানে চামড়া, তিন জায়গা থেকে এনে বেঁধে গেঁথে শরীরের রচনা। তার বদলে বুঝতে শেখো যে, একটা শরীরকে তার আস্ত শরীরত্বে চিনতে শিখলে তবে বুঝবে অন্য শরীরের সঙ্গে তার আত্মীয়তা কীভাবে রক্তে সাড়া তোলে, চামড়ায় শিহরণ জাগায়, হাড়কেও কাঁপিয়ে দেয়। শরীরটাকে যদি চিনতে চাও তাহলে টুকরো টুকরো করে কেটে কিছু পাবে না। ‘এই নে বুক, মুখ, হাত নে, পা নে,/ ভাবিস পাবি তবু আমার মানে?’

সমাজভাষাতত্ত্বে এ-ভাষ্যের অবতরণ ঘটে যখন আমাদের চোখে পড়ে যে একেকটা ভাষার বিশেষ বিশেষ সংকেতন যখন মিলে মিশে দ্বিসংকেতনের শরীরত্বে বিধৃত রয়েছে তখন তাদের কেটে আলাদা করে কোনো ভাষ্য দাঁড়াবে না। যে যার বাসায় যেভাবে বাস করে তার স্থৈর্যের অটুট সম্মান রক্ষা করে অনুবাদমূলক সেতু নির্মাণের পন্থাতেই বিশ্লেষণ এগোতে পারবে। এ-কাজের মূলসূত্র হল, ভাষায় ভাষায় যে-সম্পর্ক সেটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ইন্দ্রিয়সর্বস্ব আকরণিক সম্বন্ধ নয়। কথাবার্তার আর বাচকতার সক্রিয় মানবিক সংযোগই সেখানে প্রধান। তাই সেতু তৈরি করে চলাচলের ওপর জোর দেওয়াটাই আসল কথা। সেতুবাদের দিকে, নিরপেক্ষতার দিকে, ভাবের অবাধ লেনদেনের দিকে এসপেরান্তোভাষীদের মূল ভাবনার যে-ঝোঁক, তার সঙ্গে কায়াবাদের সাযুজ্য স্পষ্ট ঠিকই। কিন্তু আমি যৌগিক ক্রিয়াপদের কিংবা ভারতে ইংরিজির অবস্থানের ভাষ্য লিখতে বসে এসপেরান্তো ভাবনীতির সূত্রে ধরে এগোইনি। কায়াবাদের উৎপত্তিতে এসপেরান্তোর কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। কায়াবাদী ব্যাকরণতত্ত্বের ইস্তাহার হিসেবে ‘আফটার এটিমোলজি’ উল্লেখযোগ্য (দাশগুপ্ত, ফোর্ড আর সিং ২০০০)।

সেই-যে এসপেরান্তো ভাষায় সাতাত্তর সালে বক্তৃতা দিয়েছিলাম, সেই বক্তব্য পরবর্তী কালে ইংরিজিতেও খুলে বলার অবকাশ পাই। তখন খুলে বলতে পেরেছি যে দ্বিসংকেতনের মূল চাবিকাঠি ভাষার আকৃত সংকেতনের নির্মিতিতে নেই। আছে ভাষীদের হালকা থেকে ভারি নানা রঙের নানা ওজনের বাচকতার চলাফেরায়। দ্বিসংকেতন আদৌ শব্দের সঙ্গে শব্দের আমলাতান্ত্রিক সমীকরণের হিসেব নয়। মানুষের কথাবার্তার সঙ্গে ভিন মানুষের কথাবার্তার সেতুসন্ধানের কাহিনি। দ্বিসংকেতন না বললে দ্বিবাচকতা বললে সুবিধে হয় বুঝতে।

আমার ভাষ্যটা যখন গ্রন্থাকারে বেরোয় (দাশগুপ্ত ১৯৯৩) তখন-যে পাঠকসমাজ তৈরি ছিল সেটা পাঠকদেরই কৃতিত্ব, তাতে আমার কোনো অবদান নেই। ‘মাসির ভাষা’ বিশ্লেষণটা এত লোকের এমন সহৃদয় অভ্যর্থনা পাবে এটা আমি ভাবতেও পারিনি। এদেশে ইংরিজির অবস্থান বিষয়ক মনোযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে বইটাকে যেভাবে জায়গা দেওয়া হল তাতে একটু অবাকই হলাম। যাই হোক, বিষয়টি নিয়ে যাঁরা আগ্রহী তাঁরা অনেকেই এই ‘মাসির ভাষা’ কথাটা শুনেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। এবার হয়তো তাঁরা মন দিয়ে দ্বিসংকেতনের সঙ্গে এ-ভাষ্যের সংযোগের জায়গাটা অনুধাবন করে এখন বিষয়টা নিয়ে নতুন করে ভাবতে রাজি হবেন। ভাবতে গিয়ে তাঁরা যদি সিদ্ধান্ত নেন যে আমার কথাটাকে এবার খারিজ করে দেবেন তাতে কোনো মুশকিল নেই। প্রশ্নটা সত্যাসত্যের, আমার কথা বনাম অন্য কারুর কথার বিবাদ নয় এটা।

পাঠকের গ্রহণ-বর্জনের কাজের পথ সুগম করবার জন্যে আমি গ্রন্থপ্রকাশের অল্প দিন বাদে তার প্রধান প্রধান বক্তব্যের যে-সারসংক্ষেপ করেছিলাম (দাশগুপ্ত ১৯৯৮) তার তরজমা আপনাদের সামনে পেশ করে নিয়ে তারপর ফিরে আসব বক্ষ্যমাণ রচনার কর্মসূচিতে।


।।ইং রি জি    আ র   ভা র তী য়  ভা ষা:   ভি টে – ভা ষা – ভি ত্তি ক    বি শ্লে ষ ণ।।

বর্তমান ভাষ্যের সানুপুঙ্খ উপস্থাপন পেশ করা হয়েছে অন্যত্র (দাশগুপ্ত ১৯৯৩)। আশা করি সে-বইয়ের বর্তমান সারসংক্ষেপে কয়েকটি বক্তব্য যেভাবে দাখিল করা হল তাতে পাঠকদের লাভ হবে, বিশেষ করে যাঁরা সমালোচনা করতে চান তাঁদের।

১। ভাষাতাত্ত্বিকরা যখন বলেন আমরা কিছু শব্দ অন্য ভাষা থেকে ‘ধার’ নিয়েছি, তখন ধরে নেওয়া থাকে নিজস্ব শব্দসম্ভারকে আমাদের একরকম সাংস্কৃতিক ভিটেমাটি বলে গণ্য করতে পারি। এই ভিটেমাটিতেও খোঁড়াখুঁড়ি করলে নিশ্চয়ই বেরোবে মাটির প্রত্যেক স্তরের বয়স সমান নয়। তাহলেও নবাগত শব্দগুলো যে-মৃত্তিকার আতিথ্য পাচ্ছে সে-মাটিটাকে মোটের উপর ভিটেমাটি বলে শনাক্ত করলে নিজের আবাদ আর পরের আবাদের মস্ত কোনো ভুল পরিচয় দেওয়া হবে না। এভাবে হিসেব করলে ইংরিজি ভারতের ভিটে-ভাষাগুলোর কোঠায় পড়ে না, এদেশে ইংরিজিকে ধার নিয়েছি আমরা।

২। অবশ্য কিছু কিছু ভারতীয় আছে যাদের ভিটেমাটি পালটে গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ইংরিজিভাষী পশ্চিমে দীর্ঘকাল কাটিয়েছে বা কাটাচ্ছে (অথবা সেরকম কোনো দেশের সঙ্গে পূর্ণমনস্ক নিয়মিত যোগাযোগ রাখে)। সেই ভারতীয় ব্যক্তিদের জীবনে ইংরিজি ভিটে-ভাষা বলে গণনীয়। সংস্কৃতির গণনায় ধরা যায় তারা পশ্চিমে যোগ দিয়েছে।

৩। ইংরিজিতে ওই বর্গের মানুষেরা যখন সাহিত্য রচনা করে তখন ওদের ওইসব বয়ানের সঙ্গে আন্তর্বয়ন ইংরিজিরই অন্যান্য বয়ানের; ভারতীয়দের রচনাবলির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না সে-হিসেবের। ইংরিজি সাহিত্যের ধারার উপধারা হিসেবে বইতে থাকে ওদের লেখাগুলো। ইঙ্গভাষী দুনিয়ায় একরকম ‘গেটো’র পরিচিতি লাভ করে, অর্থাৎ মূলস্রোতের সঙ্গে অসম্পৃক্ত পৃথগন্ন পাড়ার পরিচিতি।

৪। ও-পাড়ায় যত অট্টালিকাই নির্মিত হোক না কেন, তা সত্ত্বেও ওই রচনাধারা সেই অর্থে অসন্তত থেকে যাবে, সাংস্কৃতিক বংশরক্ষায় অসমর্থ থেকে যাবে, যে-অর্থে ঘোড়া বা গাধা বংশরক্ষা করতে পারে কিন্তু খচ্চর তা পারে না। ‘ভারতীয় ইংরিজিতে রচিত সৃষ্টিকর্ম’ আর আধুনিক যুগের প্রকৃত স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত সাহিত্যধারার একটা জরুরি তফাত এইখানে দেখতে পাই আমরা – কাম্যু-র সঙ্গে তাঁর আধুনিকতার ভাষ্যকার বার্তের কিংবা বালিবারের যে-সম্পর্ক চোখে পড়ে সেভাবে কোনো ভারতীয় ইংরিজি সাহিত্যস্রষ্টার হয়ে সেই বর্গের অন্য কোনো রচয়িতা অবিচ্ছিন্ন বা প্রবহমাণ চিন্তাশীল ভাষ্য রচনা করেন না। অর্থাৎ আন্তর্বয়নের বাচকীয় ভাষ্যের পন্থায় ‘ভারতীয় ইংরিজি সাহিত্য’ নিজের বংশরক্ষা করে না – ইংরিজি সাহিত্যের বৃহত্তর সাহিত্যশালার ধ্বনি-প্রতিধ্বনির দিকেই সে নীরবে দেখায় অঙ্গুলি তুলি।

৫। এখানে ভারতের ভিটেমাটির নিজস্ব ভিটে-ভাষায় রচিত সাহিত্য নিয়ে কথা বলছি না। সেইসব সাহিত্যের বংশরক্ষার সামর্থ্যের প্রতিপাদন অনেক দিন ধরেই পাওয়া গেছে। ইংরিজিতে ভারতীয়দের যে-রচনাধারা ‘সন্তত’ অর্থাৎ অবিচ্ছিন্ন বংশরক্ষার সামর্থ্য দেখিয়েছে তা হল, ধার-নেওয়া এই ভাষায় এদেশের লোকেরা যেসব বাচকীয় রচনা করে গেছে, যেখানে সৃষ্টিটা প্রধান নয়, মননধর্মিতাই প্রধান, সেই কাজের প্রবাহ। সেসব লেখার বর্ণচ্ছটা রাজনীতি থেকে আধ্যাত্মিক অদ্বৈতমার্গ হয়ে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পর্যন্ত বিস্তৃত। ইংরেজদের কাছে ন্যায়বিচার চেয়ে দীর্ঘ আইনমূলক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে দাদাভাই নওরোজির, রমেশচন্দ্র দত্তের, মহাত্মা গান্ধির যে-পরিস্ফুটনের কৃতিত্ব পর পর দেখা গেছে তাকে খালি ইংরিজিতে ভারতীয়দের রচনার মননধর্মী বাচকীয়তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ভাবলে চলবে না। লক্ষ করা দরকার যে ওই পরম্পরার প্রবহমাণতা থেকে প্রমাণ হয় যে ওই ধারাটা নিজেকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

৬। ভারতের ভিটেমাটির বিভিন্ন ভাষা থেকে এখন উঁচুদরের সাহিত্যের ইংরিজি অনুবাদ পর পর বেরোচ্ছে। এইসব অনুবাদের অবস্থান ঠিকমতো বুঝতে চাইলে এদের সঙ্গে মননধর্মী বাচকীয় আত্মপ্রকাশের প্রবাহের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা চিনে নিতে হবে, নইলে এ-অনুবাদকেরা নিজেদের অস্তিত্বের আর কাজের অবিচ্ছিন্ন যুক্তিসহ ভাষ্য দিতে পারবেন না। একবার যদি বিশ্লেষণমূলক বাচকীয় প্রবাহের এ-জায়গাটাতে অনুবাদের কাজের ধারাকেও বসাতে পারি তাহলে বুঝতে পারব যে ভারতীয়রা নিজেদের কোনো কোনো লেখাকে-যে ‘সৃষ্টিশীল রচনা’ বলে গণ্য করেন সেগুলোও এই অনুবাদকর্মেরই অঙ্গবিশেষ, এবং অনুবাদের কাজটাও বৃহত্তর বিশ্লেষকীয় প্রবাহের অন্যতম ধারা বলে গণনীয়।

৭। বিশ্লেষণমূলক এই বাচকীয় ধারাটাকে আমাদের ভাষ্যের কেন্দ্রে যদি এভাবে বসাতে পারি তাহলে আর ভাবতে বসব না, ভারত কেন ইংরিজি ব্যবহারের নিজস্ব জাতীয় প্রতিমান নির্মাণ করে তার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা বা ও-ভাষায় বইপত্র প্রকাশের ব্যবস্থা চালায় না; অর্থাৎ ইংরিজির স্বতন্ত্র অভিধান কিংবা ব্যাকরণ কেন ভারত থেকে বেরোচ্ছে না তা নিয়ে আর বিস্ময় প্রকাশ করব না। ভারতীয়রা যখন মন দিয়ে ইংরিজি বলতে বা লিখতে চায় তখন-যে তাদের যত্নের ধরনগুলো ইংলণ্ড আমেরিকার মতো মহানগরস্থানীয় দেশের অভিকর্ষক্ষেত্রে প্রবেশ করে এ নিয়েও তখন আর আক্ষেপ করতে চাইব না আমরা। আমরা যদি বিশ্লেষকীয় কাজ করবার জন্যে কোনো চিহ্নতন্ত্র অন্যদের কাছ থেকে ধার নিই – যেমন রাসায়নিক পদার্থের প্রতীক যদি আন্তর্জাতিক কোনো পর্ষদের প্রতীকতন্ত্র থেকে গ্রহণ করি – তখন তো ধরে নেবই যে সেই তন্ত্র বলবৎ রাখার এবং মাঝে মাঝে তার সূত্রের বিবর্ধন আর রদবদলের দায়িত্ব সেই বাইরের কর্তৃপক্ষের হাতেই ন্যস্ত থাকবে, ওটা আমাদের দায়িত্ব নয়। এও তেমনি। ধরা যাক ক্রেতা বা অধমর্ণ হিসেবে আমাদের শিক্ষার্থীদের দরকারের কথা ভেবে আমরা বাংলা পাঠ্যবইয়ে অক্সিজেন অর্থে O আর হাইড্রোজেন অর্থে H-এর গায়ের ওপর বাংলা সংখ্যাচিহ্ন ২ কিংবা ৩ চাপিয়ে দিতে রাজি থাকি, সেটুকু নিজেদের দায়িত্বেই করি, আন্তর্জাতিক রাসায়নিক পর্ষদকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত না করে – আমাদের দেশের দরকারের সঙ্গে সেই খাপ খাইয়ে নেওয়াটুকু করছি বলেই আমরাও ওই ধার-নেওয়া তন্ত্রের মালিক বলে ভাবতে শুরু করব, এভাবে তো লেনদেনের বা মালিকানার যুক্তি চলে না। অবশ্য যে-ভারতীয়রা ভিটেমাটি পালটে আদতে ইংরিজিভাষী হয়ে গেছে তাদের কথা স্বতন্ত্র, ২ নম্বর সূত্র দ্রষ্টব্য।

৮। আবার এটুকু বলা নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয় যে ভারতীয়রা ইংরিজির মাধ্যমে মননধর্মী লেখার কাজে ব্যাপৃত – মানুষের কোনো কাজই তো নিছক হয় না, জানতে চাওয়া দরকার এই কাজটার পিছনে কী ধরনের ছক সক্রিয়, ইংরিজিতে যখন ভারতীয়রা মননশীল কিছু লেখে তখন কোন্‌ বড়ো মাপের উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে কাজের সেই ধারাটাকে বসালে তাদের নিজস্ব অনুধাবনের সঙ্গে সামাজিক ভাষাতাত্ত্বিকের ভাষ্যের সামঞ্জস্যসাধন সহজ হবে। এ-প্রশ্নের কোনো নিষ্কণ্টক জবাব হয় না। কেউ আদি দৃষ্টান্ত হিসেবে গান্ধিকে তুলে ধরবেন, কারুর বা রজনী পাম দত্তর দিকে কিংবা নেতাজির দিকে ঝোঁক, কেউ বা বলবেন মানবেন্দ্রনাথ রায়কে কষ্টিপাথর হিসেবে বরণ করেই বিচার করা উচিত এ-কাজের কোন্‌ ধারা আসল এবং কোন্‌ ধারা ফালতু। এসব তর্কবিতর্কে আমরা বড়োই চট করে জড়িয়ে যাই – খেয়াল করি না যে উল্লিখিত মনীষীরা সকলেই কোনো না কোনো ধরনের জাতীয়তাবাদের আদলের প্রবক্তা ছিলেন, প্রত্যেকেই বিশেষ করে ভারতের পক্ষে আধুনিক দেশ হওয়া বলতে কী বোঝায় এই এক তথা অদ্বিতীয় প্রশ্নেরই নানারকম উত্তরের উনিশ বিশ নিয়ে পাঞ্জা লড়ছিলেন বিভিন্ন পক্ষ প্রতিপক্ষ সাজিয়ে।

৯। ভারতে আধুনিক মনের সূত্রপাত কবে? নির্দিষ্ট কোনো সনতারিখ দিয়ে তো এরকম প্রশ্নের যুক্তিসহ উত্তর দেওয়া যায় না। সমাজে পরিবর্তন হতে থাকবে ধরে নিয়েও যে-সংস্কৃতি নিজস্ব রীতি বজায় রেখে বংশরক্ষা করতে জানে তাকেই যদি আধুনিক বলি, তাহলে আধুনিক ভারতের বিশেষ নিজস্ব রীতির গোড়াপত্তন ঘটে মধ্যযুগের সেই পালাবদলে যাকে অনেকে ভক্তিচিহ্নিত হিন্দু ধর্ম বা সুফি আদলের ইসলাম বলে চেনেন। ওই সময়ে পুরুতদের সংস্কৃত আর রাজাগজাদের ফারসির সঙ্গে কথাবার্তায় প্রচলিত ভিটে-ভাষাসমূহের সম্পর্ক আমূল পালটে যায়। ভারতের সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের চাবি ওই সময়ে গগনমার্গী উচ্চবর্গের হাত থেকে চলে আসে মাটিতে পা ঠেকানো সাধারণ মানুষের হাতে।

১০। এদিকে ইংরিজি যেদেশে ভিটেমাটির ভাষা নয় সেদেশে তো দ্বিসংকেতন-বিদ্ধ সাংস্কৃতিক বন্দোবস্তের দুর্গম উচ্চাসনে বসা ছাড়া ইংরিজির আর কোনো গতি নেই। আমরা অনেকেই মনে করি ইংরিজির সাহায্যে আমাদের নানারকম উপকার হতে পারে। ধরে নেওয়া যাক কথাটা অমূলক নয়। তাহলেও ওই উপকার যাতে আরও বেশি কার্যকর হয় তার জন্যে খুঁজে দেখা দরকার আমাদের নিজস্ব ভিটে-ভাষাগুলোর উঁচু নিচু আনাচে কানাচে কী ঘটছে না ঘটছে। ওখানেই তো ভারতীয় আধুনিকের দরকষাকষি চলছে। অর্থাৎ আমাদের ইংরিজির চর্চা কী করে আমাদের ভিটে-ভাষাগুলোর চর্চার মুখাপেক্ষী হতে পারে, সে-ব্যবস্থা করতে শিখতে হবে। নইলে কাজটা এগোবে না।

১১। বর্তমান যুক্তি থেকে এও প্রতিপন্ন হয় যে, ৮ সংখ্যক বক্তব্যে ভারতের যে-বিশেষ নিজস্ব আধুনিক মেজাজের উল্লেখ ছিল, ৪ সংখ্যক বক্তব্যে যার ইংরিজিভাষী সংস্করণের আত্মচেতনার অভাবের কথা বলা হয়েছিল, সেই মেজাজের শ্রীবৃদ্ধির কাজ একমাত্র ১০ সংখ্যক বক্তব্যে যাকে আমাদের ‘ভিটেভাষার চর্চা’ বলা হয়েছে সে-জায়গাতেই করা সহজ, কারণ সেখানেই বিভিন্ন মহলের অভিজ্ঞ মানুষের সমাবেশ একইসঙ্গে এ-কাজে আগ্রহী এবং পারঙ্গম।

১২। একদা আধুনিকতা অনেক মানুষকে সরল বিশ্বাসে দীক্ষা দিয়েছিল। সে-বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক চেহারা বলত, প্রযুক্তির বিবর্তনে নিশিদিন ভরসা রাখিস, হবেই হবে মানবজাতির চরম প্রগতি, পৌঁছে যাবই যাব সব পেয়েছির দেশে। তার দোসর ছিল কিছু কিছু সাহিত্যিকের অর্ধচিন্তিত বিশ্বমানবীয় আধুনিকবাদ, যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে তিরিশের দশকে। ওই কার্যক্রমের উভয় চেহারাতেই আধুনিকতার মেজাজ এক ধরনের নিদর্শবাদী বা এমপিরিসিস্ট ব্যবস্থাপনের ভাবনীতিকে সর্বজনীন কাণ্ডজ্ঞান বলে বরণ করেছিল। এদিকে এই ধরনের নিদর্শবাদের দাপট এমনিতেই দেখা গেছে কয়েকশো বছর ধরে প্রধানত ব্রিটেনের সমাজে এবং ভাষায় – আধুনিকতার দৌলতে সে-জিনিস ছড়িয়ে গেল সারা পশ্চিমে। বিভিন্ন পশ্চিমি শক্তির মধ্যে তাকে নিরপেক্ষ দেখায় বলে তাকে গ্রহণ করতে তৃতীয় বিশ্বের উচ্চবর্গের চিন্তাশীলরাও রাজি হয়ে গিয়েছিলেন; ভাববিনিময়ের একটা কিছু নিশ্চিন্ত ভিত্তি থাকলে যে-সুবিধে হয় তার আকর্ষণে লোকেরা নেই-কড়ির চেয়ে কানাকড়িকেও বরণীয় মনে করতেই পারে, এতে অবাক হবার কী আছে। তবে আজ তো যুগ পালটাচ্ছে। আধুনিকতার মূলমন্ত্র যে-উন্নয়ন তাকে জনসাধারণের পছন্দের কাছে নত হতে বাধ্য করার যে-অধুনান্তিক তাগিদ আজ আমাদের কর্মসূচি বদলাতে বলছে সেই সূত্রে আজকের ভারতীয়দের হাতে আসছে বিভিন্ন দাপটের প্রতিরোধ করবার মতো সাহস, সম্বল, সরঞ্জাম। নিদর্শবাদ-বিদ্ধ ইংরিজি ভাষা তথা সাহিত্যের কারখানা সেইসব দাপুটে শক্তির গোত্রভুক্ত যাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আমরা এবার অবশেষে সত্যিসত্যিই পারব। কিন্তু অধুনান্তিকতা ব্যাপারটাও সকণ্টক। আমরা যারা অধুনান্তিকের অঞ্চলবাদী ভাষ্যের শরিক, যারা ভারতের নিজস্ব আধুনিকতার যাত্রা অব্যাহত রাখার উপায় খুঁজছি, তাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হল পোশাকি অধুনান্তবাদের ফ্যাশনমনস্ক বাগভঙ্গির আতিশয্য।

সেই আতিশয্যের জাল কেটে বেরিয়ে এসে কোনো কোনো বড়ো মাপের কর্মী – যেমন গায়ত্রী স্পিভাক আর দীপেশ চক্রবর্তী – আমাদের মনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি যে-ঘরানার কর্মী তাকে বলি ‘অধুনান্তজ’, ট্রান্সমডার্ন। এ-বিষয়ে আরও বাক্যব্যয় করেছি আমার ‘ছিন্ন কথায় সাজায়ে তরণী’ গ্রন্থে (কলকাতা: গাঙচিল, ২০১১)। হঠাৎ ২০১১-য় পা দিচ্ছি দেখে, এবং বর্তমান অনুচ্ছেদের আদিতে ‘১৩’ সংখ্যাটা নেই লক্ষ করে, সতর্ক পাঠক আন্দাজ করে থাকবেন যে সংখ্যাঙ্কন থামিয়ে দিয়েছি ‘দি আদারনেস অভ ইংলিশ’ বইয়ের সারসংক্ষেপের সেই মূল বয়ানটার অনুবাদ শেষ হয়ে গেছে বলে। শুরু হয়ে গেছে বর্তমান মুহূর্তের উপযোগী সংযোজনের কাজ। যাঁরা পোশাকি ভাষাতত্ত্বের মূলসূত্র দেখে নিতে চাইবেন তাঁদের কাজে লাগবে ‘ভাষার বিন্দুবিসর্গ’ বইটাও (কলকাতা: গাঙচিল, ২০১২)।

অধুনান্তজ কার্যক্রমের সহকর্মী হতে হয়তো এগিয়ে আসবেন এমন অনেকে যাঁরা প্রথম দর্শনে আমাদের ঘরানার সঙ্গে খাস অধুনান্তবাদী আতিশয্যকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তফাতের একটা জায়গা এই যে অধুনান্তজ ভাবনা পরিবেশবাদী এবং সেইজন্যে বিজ্ঞানকে নিশ্চিন্ত প্রযুক্তিবাদের গ্রাস থেকে বাঁচাতে উদ্‌গ্রীব। যেসব চিন্তাশীল বৈজ্ঞানিক আধুনিকতাকে বৃহত্তর চিন্তার প্রাঙ্গণে স্থান দেবার অভিপ্রায়ে ইহবাদ অর্থাৎ সেকুলারিজমের মননরীতির শ্রীবৃদ্ধির প্রয়াসে নিযুক্ত তাঁদের কথা ভাবছি বিশেষ করে।

ইহবাদীরা জানেন, মাটিতে যে-মানুষ চলে ফেরে, মেঘের আড়াল থেকে আকাশবাণী বিতরণ করে তার শাসনের কাজ চলতে পারে না। আইনের শৃঙ্খলমুক্ত মগের মুল্লুক-জাতীয় স্পেশাল ইকোনমিক জোনে দরিদ্র আর নিরক্ষরদের শোষণ করে নিজেরা আরামের সিংহাসনে বসে থেকে যে-ইংরিজির নিদর্শবাদী প্রবক্তারা পৃথিবী চালানোর দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের তাসের ঘর কোনো একদিন চোখের সামনে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে কিনা সেটা প্রশ্ন নয়। আর্থসামাজিক সংকটে জর্জরিত হয়ে, পৃথিবীর উষ্ণায়ন আর পরিবেশদূষণের প্রকোপবৃদ্ধির ফলে বিশ্বাস্যতা হারিয়ে, ভোগবাদী ধনতান্ত্রিক জীবনরীতি দেউলে হয়ে যাবে কিনা সেটাও জিজ্ঞাস্য নয়। যে-প্রশ্ন সত্যিই বিবেচ্য তা হল, ভেঙে যখন পড়বে তখন যাতে সকলে বাসযোগ্য কোনো বিকল্পে অবিলম্বে প্রবেশ করতে পারে সেজন্যে আমরা যারা পরিবেশবাদী তারা কতটা সুচিন্তিত বিকল্পের প্রস্তুতির কাজ গুছিয়ে রাখতে পারছি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে এসপেরান্তো নিয়ে ভাবতে আমি সেই ভারতীয় চিন্তাশীলদেরও বলব যাঁদের নিজেদের এসপেরান্তো শিখবার সময় বা প্রবৃত্তি হবে না। পরিবেশবাদীদের কাঙ্ক্ষিত নতুন বিশ্বে আমরা ভাষার ব্যাপারে কী স্বপ্ন দেখব? ভোগবাদী বিশ্বে ইংরিজি ছিল, লোভকে জয় করার পর বাস্তববাদী পরিবেশ-সংরক্ষণ-সচেতন দুনিয়ায় তার স্থলে এসপেরান্তো অভিষিক্ত হবে, এই কি আমাদের আন্দোলনের সুসমাচার যা দিকে দিকে প্রচার করে বেড়াচ্ছি?

যে-পাঠক এটাকে আমাদের অবস্থান বলে মনে করেন তিনি স্পষ্টতই জানেন না যে দেশে দেশে ভাষা সমস্যার প্রকোপ বৃদ্ধি দেখে, যাদের ভাষা অবহেলিত তাদের নিপীড়িত বোধ করার জায়গাটাতে এখনকার সামাজিক বিদ্যার সরঞ্জামে যথোচিত সংবেদ সহকারে চিন্তাশীলরা পৌঁছোতে পারছেন না দেখে, বিশ্ব এসপেরান্তো সংস্থা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ষাটের দশকে ভাষা-পরিকল্পনা বিষয়ক সমাজভাষাতত্ত্বের জন্যে আস্ত একটা নতুন কাগজ চালু করেছিল, লিংহ্বাই প্রোবলেমোই কাই লিংহ্বো-প্লানাদো, ল্যাংগুয়েজ প্রবলেমস অ্যাণ্ড ল্যাংগুয়েজ প্ল্যানিং। ইংরিজি ফরাসি জার্মান রুশ ইটালিয়ান প্রভৃতি ভাষায় ওই কাগজে প্রবন্ধ লিখে লিখেই ভাষা-পরিকল্পনার জ্ঞানমঞ্চ সাজিয়ে বসে সমাজতাত্ত্বিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষাতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক, ব্যবস্থাপনতাত্ত্বিকের দল আজ এতটাই শিখেছেন, এতখানি হাত পাকিয়েছেন যে দেশে দেশে রাজাপ্রজা এখন তাঁদের পরামর্শ নিয়ে ভাষা-নীতি স্থির করেন। আমরা এসপেরান্তোর জন্যে কাজ করি তার মানে এ নয় যে অন্য কোনো ভাষার কারুর জন্যে আমরা নিঃস্বার্থে নিজেদের সময় আর রসদ খরচ করি না মানুষের বৃহত্তর কর্মসূচিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে।

এল পি এল পি কাগজটাতে পর পর যেসব আলোচনা হয়েছে তা থেকে খালি যে আন্দোলনের বাইরের বিবিধ পণ্ডিত (এবং তাঁদের পরামর্শ-ধন্য নানা দেশের সরকার আর জনসাধারণ) উপকৃত হয়েছেন তাই নয়। আমরা যারা এসপেরান্তো চর্চা করি তারাও ওই আলোচনাধারার ক্রমবিবর্তনে শিখেছি যে সারা দুনিয়ায় কোনো একটা ভাষা-সমস্যা নেই এবং কোনো একটা সমাধানকে সর্বত্রগামী ভাবলে সাম্রাজ্যবাদেরই নতুন কোনো আদলের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলব সকলে। এভাবে সূচনা হচ্ছে আমাদের নিজস্ব বিকেন্দ্রিকতার, নিজস্ব ভাষাগত পরিবেশতত্ত্বের, নিজস্ব অধুনান্তিক বিশ্ববীক্ষার।

সে-বীক্ষার সঙ্গে প্রচুর মিল আছে ভারতীয় মেজাজের। ভারতে মানুষ শিখেছে যে অনেক সমবায়ের লোক যদি মিলে মিশে থাকতে চায় তাহলে যে যার নিজের ঘরের স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় কাছের মানুষের সঙ্গে যা যা লেনদেন করছে সেই ভাষার চৌহদ্দিটাকে ঠেলাঠেলি করে বেশি দূর নিয়ে যাবার চেষ্টা করে ভালো ফল পায় না। ভারতের অনেক এলাকার মধ্যে যোগাযোগের কিছু কিছু প্রয়োজন হিন্দিতেই ভালো মেটে। অন্য কিছু কিছু কাজে ইংরিজির (বিশেষত কোনোরকমে জুটিয়ে নেওয়া ভাঙা ভাঙা ইংরিজির) আপাতত বিকল্প নেই; খুব শিগগির হয়তো কোনো বিকল্প তৈরিও হবে না। আবার আন্তঃপ্রাদেশিক কোনো কোনো মহলের সেতুসাধনের কাজের পক্ষে পথ-চলতি, হাটে-বাটে ব্যবহার্য খিচুড়ি ভাষা – বিহার-ঝাড়খণ্ডের সদরি কিংবা উত্তরপূর্ব ভারতের অসমিয়া-নাগা-মেশানো নাগামিজ যেরকম খিচুড়ি, সেইরকম সেতুভাষা – একেবারে অপরিহার্য। বলে লাভ নেই যে হিন্দি ইংরিজি সদরি নাগামিজের এই বৈচিত্র্য ঘুচিয়ে দিয়ে কোনো একটা সমাধান কেন্দ্র থেকে ভেবে চিন্তে সকলের উপর চাপিয়ে দিতে পারলে সকলেরই খাটনি বাঁচবে। ভাষার পরিবেশতন্ত্রের দরকার অন্যরকম। অল্পবিস্তর কৃত্রিম এই সমাধানগুলো বিভিন্ন বহরের লেনদেনের বহরমাফিক বিশেষ প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খায় বলেই তাদের বিকাশ ঘটেছে। অন্দরের স্বাভাবিক আস্ত ঘরোয়া ভাষার পাশাপাশি সদরের খানিকটা জোড়াতালি দেওয়া বে-ঘরোয়া অর্ধভাষার এই সহাবস্থান ভারতের তাপ্পি দিয়ে সামলে সামলে চলার কায়দাটারই অন্যতম নিদর্শন। ওই জোড়াতালি দেওয়ার দস্তুরের আকৃত রূপ বলে পৃথিবীর পরিবেশতন্ত্রে এসপেরান্তোকে যদি আমরা চিনতে পারি তাহলে ভারতের একান্ত নিজস্ব আধুনিক চলনরীতির সঙ্গে এই বিশ্বজনীন ভাষার প্রকল্পের আত্মীয়তা আমাদের অন্যতম সম্বল হয়ে উঠবে।

আশা করছি নিজেদের সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে সহমর্মী অনেকেই ক্রমশ দেখতে পাবেন যে, আকাশমার্গে বিচরণ করতে না চেয়ে সসীম মর্ত্যবাসী হিসেবে সেতু নির্মাণের যে-পন্থা ইহবাদী মাত্রেরই ইষ্ট, সেই পন্থার সঙ্গে এসপেরান্তোর কর্মীদের মনের মিল রয়েছে গোড়া থেকেই। সে-অর্থে এসপেরান্তো আন্দোলন ইহবাদের পথিকৃৎ বলে স্বীকার্য। প্রত্যেক দেশে যাঁরা এসপেরান্তো নিয়ে কাজ করেন তাঁরা জানেন, দেশবিশেষ বা অঞ্চলবিশেষের কর্মীদের কোনো অগ্রাধিকার নেই, সকলের উদ্যোগের সমাহারেই ক্রমশ এগিয়ে চলে জনপথের এই জনরথ। ইংরিজির রাজধানী ইংল্যাণ্ড আমেরিকায়; এসপেরান্তোর ‘প্রাজধানী’ সর্বত্র – যে-‘প্রাজধানী’ প্রজাদের পারস্পরিক শাসনবৎ সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াসের মজার নাম হিসেবে লাগিয়ে দেখছি এই বাস্তবটার গায়ে। এই লাগিয়ে দেখাগুলোই এসপেরান্তোর খালি মজার জায়গা নয়, প্রজাতন্ত্রেরও জায়গা।

যাঁদের চিন্তারীতিতে এ-আলোচনার পাশাপাশি উচ্চমার্গীয় দস্তুরমতো দর্শনের আর ভাষাতত্ত্বের মশলার আমদানি আবশ্যিক ঠেকবে, তাঁদের অনুরোধ করব আমার ২০১১-য় প্রকাশিত ‘ইনহ্যাবিটিং হিউম্যন ল্যাংগুয়েজেস’ পড়ে নিতে। কিন্তু এবার আমাদের বর্তমান লড়াইটাকে ফিরিয়ে আনতে চাইব প্রকাশ্য পরিসরের আলোচনার প্রাঙ্গণে।


।।ভি টে মা টি র   আ বা দ    আ র     প থ     চ লা।।

    কেউ কেউ ভাববেন, আমার বক্তব্য কতটা স্ববিরোধী সেটা আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি না। তাঁরা বলে উঠবেন, ‘তুমি এক মুখে বলছ জমির লড়াইয়ের স্লোগান তোলা নাকি শস্তা জনবাদ, আর অন্য মুখে বলছ ভারতীয় ভাষা আমাদের আসল ভিটেমাটি, ইংরিজি নাকি ধার-করা ভাষা। বাজে কথা ছাড়ো। তুমিও তো জমির লড়াইয়ের হয়েই সওয়াল করছ দেখতেই পাচ্ছি। তাহলে ঝেড়ে কাশো। তোমার মতলবটা ঠিক কী?’

    ঝেড়ে কাশতেই তো চাইছি। যে-পাঠক ভিটেমাটির সঙ্গে জমির তফাত বুঝতে পারছেন না তাঁকে ধৈর্য ধরে বুঝিয়েই বলব আমার বক্তব্য কী। কথাটা কাটতে চান নিশ্চয়ই কাটবেন, কিন্তু না বুঝে শুধু শুধু ঢিল ছুঁড়বেন না, তাতে আপনারও সময় নষ্ট।

আমার বন্ধু আলোক ভাল্লা উত্তরপূর্ব ভারতে কিছু দিন কাজ করেছিলেন। সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে মিশে তাঁর গান্ধিবাদ আরও স্পষ্টতা পায়। আমার কম বয়সে আলোক ভাল্লাই খেয়াল করিয়ে দেন যে, জোরের সঙ্গে নৈরাজ্যবাদ প্রচার করতে করতেই গান্ধিজি এও বলতেন যে রাষ্ট্রিক বা ব্যাপক-সামাজিক ক্ষমতার কোনো কেন্দ্রকে বাড়তে দেওয়া উচিত নয়, ওগুলোই যত নষ্টের গোড়া। কণিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বে অগাধ বিশ্বাস ছিল গান্ধিজির। তিনি বলতেন, মানুষ স্বভাবতই নিজের ঘর বাঁধতে চাইবে। ও-জায়গাটা তার একার বাড়িই হোক, তার পরিবারের যৌথ বাড়িই হোক, ওখানেই আত্মনিরূপণ করবে সে। অর্থাৎ ওই ভিটেমাটিকে রক্ষা করা তার কোনো রাষ্ট্রিক লড়াই নয়, মালিকানা-গন্ধী জমির লড়াই নয়, নিতান্তই তার ব্যক্তিগত আর পারিবারিক নিজস্বতা প্রতিষ্ঠা করবার এবং অটুট রাখবার অধিকারের সংগ্রাম, যেটাকে তার সাধনা বললেও অত্যুক্তি হয় না।
   
    ওটা তাহলে আপনার আমার সেই নিভৃত সাংস্কৃতিক জায়গা আস্ত রাখার লড়াই যেটাকে ইহবাদী অর্থে ‘দীক্ষা’ বলতে পারি; অর্থাৎ কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলে শিক্ষার যে-চালচিত্র আপনার আমার ব্যক্তিত্ব রচনার এবং বিকাশের জায়গা সেই ব্যাপক অর্থে ‘দীক্ষা’র লড়াই। এভাবে বলায় হয়তো ধরতে পারবেন কেন আমি মনে করি যে মানুষের ভাষাগত অধিকারের জায়গাটাকে নিছক মাতৃভাষার জমির আবাদের ছবিতে বা ভাষা-পরিকল্পনার নেশায় মত্ত ‘ভাষা পরিশীলন’-এর ছকে আটকে ফেললে গুরুতর অন্যায় করা হয়। মানুষের দীক্ষার অধিকার একটা ব্যাপক জায়গা। সেখানে আপন ভাষার সঙ্গে ভিন ভাষার প্রয়োজন মাফিক খোলামেলা চলাফেরা যেন অবাধ হয়, অনুবাদ যেন আপনার-আমার খবর রাখার আর জানতে পারার ঘাটতিগুলো পুষিয়ে দিতে থাকে, এ-দরকারটাও জরুরি। আবার অন্য দিকে ব্যক্তি হিসেবে আপনি-আমি যাতে আস্ত থাকতে পারি, নিজের পারিবারিক বাল্যশিক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখেই যাতে বড়ো হতে পারি, সে-অধিকারটাও এই বৃহত্তর দরকারেরই অঙ্গ। যখন আমরা বলি, খাসি বা মিজোদের ভাষাগত অধিকার রক্ষা করতে হবে, তার মানে তো খালি এ নয় যে তাঁদের ভাষাটুকু বিদ্যায়তনে দস্তুরমতো পঠনপাঠনে স্থান পাবে; এটাও জরুরি যে তাঁদের ভাষার সঙ্গে যেন ইংরজি হিন্দি বাংলা অসমিয়ার সমানে অনুবাদ চলতে থাকে।

    মেদিনীপুরে একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বলেছিলাম, মাতৃভাষায় শিক্ষাদীক্ষা লাভের অধিকার যাতে আদিবাসীরাও পান সেটা দেখা আমাদের সবারই দায়িত্ব। একজন লড়াকু বাঙালি ছাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমরা যারা নিম্নবর্গের বাঙালি তারা অনেক লড়াইয়ের পর নিজেদের অধিকার আদায় করতে পেরেছি সবে, আমরা কেন আদিবাসীদের জমি ছেড়ে দেব বলতে পারেন? সেদিন সেই ছাত্রীকে যা বোঝাতে পারিনি সে-কথাটাই আজ খুলে বলতে চেষ্টা করছি, পারছি কিনা জানি না। জবান-জমিনের আবাদের জ্যামিতি এমন নয় যে মেদিনীপুরের লড়াকু বাঙালি নিজের কষ্টার্জিত জমি ছেড়ে দিলে তবে সাঁওতাল ছাত্রছাত্রীর অধিকার আদায় করা সম্ভব হবে। অনুবাদের পথে পথে আমরা সবাই ঘুরি, একই ভাষার ভিতরেও ঘুরি, ভাষা থেকে ভাষান্তরে সেই পথ চলাটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে এই যা। শিক্ষাদীক্ষা ব্যাপারটাই যে সুগমের সঙ্গে দুর্গমের অনুবাদের কারবার, একথার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে আমাদের অনেকেরই দেরি হচ্ছে। এমনকি ভাষাতাত্ত্বিক মহলেও এ-ব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখেছি। মেদিনীপুরের লড়াকু ছাত্রীকে দোষ দিচ্ছি না। স্বাভাবিক কথা দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছে বেশ করেছে। আমাদের কাজ হল আস্তে আস্তে পুনর্বিবেচনা করে এমনভাবে এগোনো যাতে তার চোখে কিংবা আপনার আমার চোখে কী কী স্বাভাবিক ঠেকবে সেই বিচারের জায়গাটাই ক্রমশ সরে সরে যায়। সাংস্কৃতিক অগ্রগতি এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে ঘটতে পারে না।

    জমির লড়াইয়ে আর রক্তপাতে কোনো অগ্রগতি হবার নয়। কলমের ঘাম কাগজে ফেলে পরিশ্রম করার ব্যাপার এটা। অনেক উষ্ণকণ্ঠ বুদ্ধিজীবী দেখেছি লেখাপড়া করতে হবে দেখলে চম্পট দেন। এ-প্রবন্ধের পাঠকেরা নিশ্চয়ই সেরকম নন। তাঁরা নিঃসন্দেহে ধরতে পারছেন, নিজের ব্যক্তিত্বের আর নিকটতম স্বজনদের ক্রমবিকাশের যে-জায়গাটুকুকে ভিটেমাটি বলছি সেটা বাঁচাবার লড়াই মোটেই রাষ্ট্রিক বা বৃহৎ-প্রাতিষ্ঠানিক জমি দখলের সংগ্রাম নয়। পথ চলতে চলতে, অনুবাদ করতে করতে, নিজের ভাষার সঙ্গে ভিন ভাষার নিত্য কারবারের জ্যামিতি ধীরে ধীরে পালটাতে পালটাতেই এগিয়ে চলে দীক্ষায় পূর্ণতা আনবার লড়াইটা, তাকেই বলে ভিটেমাটি রক্ষার লড়াই। এ-কাজ করতে গিয়ে আমরা বুঝতে শিখি যে, বিপন্ন ভাষা বাঁচাচ্ছি বলতে বলতে বৈদেশিক টাকাকড়ি নিয়ে যেসব ডকুমেনটেশনের টিম এসে হাজির হয়, তারা যে-সওদাগরি সংস্থাগুলোর একক বা সামবায়িক অহমিকার হয়ে কাজ করছে, সেই জায়গাটা সবসময় আমাদের নিজেদের অগ্রগতির স্বার্থরক্ষার জায়গা হয়ে উঠতে পারে না। মাঝে মাঝে দোস্তি হয়ে যায় নিশ্চয়ই; ব্যক্তিগত সদিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করতে নেই; কিন্তু সদিচ্ছাপরায়ণ ব্যক্তি সরল অভিপ্রায়ের বশবর্তী হয়ে মাঝে মাঝে ফাঁদে পা দিয়েও ফেলে, তখন আমাদের খেয়াল করতে হবে যে, বন্ধুত্বের খাতিরে আমরা তাদের তালে তাল মেলাতে গিয়ে নিজেরাই যদি পা হড়কে গাড্ডায় পড়ে যাই তাহলে কিন্তু কেউ বাঁচাতে আসবে না।

    ‘আন্তর্জাতিক’ কর্মকাণ্ডের বেশধারী যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ ছেয়ে গেছে ইংরিজি ভাষায়। তাঁরা বলতে থাকেন, ইংরিজি নিয়ে যা জানার সবই নাকি জানা হয়ে গেছে, প্রশ্নটা নাকি আমাদের বিপন্ন ভাষাগুলো নিয়েই, আমরা যারা পৃথিবীর বেচারিতম লোকজন। এর জবাবে আমি তাঁদের বলতে বাধ্য হই, ‘তাই নাকি? ইংরিজি নিয়ে সব জানা হয়ে গেছে বুঝি? কই, টের পাইনি তো। ইংরিজিকেন্দ্রিক ভাষাতত্ত্বের সঙ্গে পথ চলে চলে জুতোর শুকতলা খইয়ে ফেললাম, তবু টের পেলাম না। সবকিছু কবে জানা হয়ে গেল, কোন বইয়ে বা কাগজে বেরোল সেই জ্ঞানামৃত, একটু দেখিয়ে দিন না।’

ভারতকে ইংরিজি শেখানোর অন্যতম সফলতার অকুস্থলে বলে জাহির করে কতটা বিজ্ঞাপনবাজি চলছে আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না। সারা ইউরোপ ছেয়ে গেছে গুজবে গুজবে। ওখানে গেলে শুনবেন, ভারতের নাকি সবাই ফুরফুর করে ইংরিজি বলতে পারে। সেইজন্যে এ-লেখায় ভারতে ইংরিজির অবস্থান নিয়ে এতটা কথা বাড়ালাম। সওদাগরদের পাঠানো ওইসব তথাকথিত জিজ্ঞাসুদের জিজ্ঞাসার বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম নিয়েও সন্দিহান হওয়ার প্রয়োজন আছে; তাদের সামাজিক মতলব নিয়েও প্রশ্ন করতে থাকা দরকার; আমাদের ভাষাগত ভিটেমাটি আস্ত রাখবার অধিকার রক্ষার সঙ্গে সে-দরকারটার যোগ আছে। তাই বলে জমির লড়াইয়ে আটকে যাওয়া কিন্তু কাঁচা কাজ হবে; ওই গাড্ডায় যদি পা দিয়ে ফেলি তাহলে যে সওদাগরদের পাঠানো দালালরা খুশি হয়ে হাততালিই দেবে, এটাও যাঁরা বোঝেননি তাঁরা তাহলে ধরতে পারেননি বিপদটা ঠিক কোথায়। ভিটেমাটিকে বাঁচানো বলতে যে নিজের ভাষাকে ঘিরে খোলা হাওয়ায় চলাফেরা করতে পারার অধিকারটাও বোঝায় একথাটা আভাসে ইঙ্গিতেই বললাম এখানে; সে-ত্রুটির জন্যে মার্জনা করবেন। যদি আরো খুলে বলতে চাই তাহলে অনুবাদতত্ত্বের উনিশ-বিশের ভিতরে ঢুকে যেতে বাধ্য হব। এ-যাত্রা সে-কাজ করা যাবে না। আশা করি মোদ্দা কথাটা খুলে বলতে পারলাম। এর পাশ দিয়ে পাঠকরা যে যার মতো লড়াইয়ের রসদ খুঁজে নেবেন। সে-দায়িত্ব আপনাদের। আপনাদের দম যেন ফুরিয়ে না যায়, এই শুভেচ্ছা রইল।


উল্লেখপঞ্জি

দাশগুপ্ত, প্রবাল। ১৯৯৩। দি আদারনেস অভ ইংলিশ: ইণ্ডিয়া’জ আন্টি টাং সিণ্ড্রোম। নতুন দিল্লি/ লণ্ডন/ থাউজাণ্ড ওক্স: সেজ।

দাশগুপ্ত, প্রবাল। ১৯৯৮। ইংলিশ অ্যাণ্ড ইণ্ডিয়ান ল্যাংগুয়েজেস: দা টার্ফ অ্যান্যালিসিস। আর. এস. গুপ্ত, কৈলাস এস. অগরওয়াল (সম্পা.) স্টাডিজ ইন ইণ্ডিয়ান সোশিয়োলিংগুইস্টিক্স। নতুন দিল্লি: ক্রিয়েটিভ বুকস। ২২৩-২২৫।

দাশগুপ্ত, প্রবাল; ফোর্ড, অ্যালান; সিং, রাজেন্দ্র। ২০০০। আফটার এটিমোলজি: টুয়ার্ডস এ সাবস্ট্যানটিভিস্ট লিংগুইস্টিক্স। মিউনিখ: লিঙ্কম অয়রোপা।

দাশগুপ্ত, প্রবাল। ২০১১। ছিন্ন কথায় সাজায়ে তরণী। কলকাতা: গাঙচিল।

দাশগুপ্ত, প্রবাল। ২০১১। ইনহ্যাবিটিং হিউম্যন ল্যাংগুয়েজেস: দা সাবস্ট্যানটিভিস্ট ভিজুয়ালাইজেশন। দিল্লি: (ইণ্ডিয়ান কাউনসিল অভ ফিলোজফিকাল রিসার্চ-এর হয়ে) সংস্কৃতি।

দাশগুপ্ত, প্রবাল। ২০১২। ভাষার বিন্দুবিসর্গ। কলকাতা: গাঙচিল।

Labels: ,

0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]

<< Home