বেড়াল, অরুন্ধতী আর বাগে আনা
বেড়াল, অরুন্ধতী আর বাগে আনা
প্রবাল দাশগুপ্ত
সমীর
রায়চৌধুরী আর রুদ্র কিংশুক-এর ‘পোস্টমডার্ন বিড়ালের সন্ধানে’ (কলকাতা: কবিতা
পাক্ষিক, ২০০১) এক অভিযানের রোজনামচা। “দেশে বিদেশে বিড়ালকে ভর করে কবি তাঁর
বাকফসল সৃজন করেছেন। এই বইতে বিড়াল কবিতার কালখণ্ডের সূচক। কবির ভাববিশ্বের বাহক”
(পৃ ৭)। বিভিন্ন কবির সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছেন লেখকদ্বয়। পক্ষিরাজ বেড়াল সেই ঘোরার
বাহন। লাফিয়ে মাটিতে নামলেও যে বেড়াল আস্ত থাকবে বলে নিশ্চিত, অতএব নির্ভয়। যে-বেড়ালের
আকাশ আর মাটির মধ্যে যাওয়া-আসা সেইজন্যে স্বচ্ছন্দ, অনায়াস। অন্য কোনো প্রাণী শুধু
যে এই আরামের ধারে কাছেও আসতে পারে না তাই নয় – পাঠক, আপনি রেহাই/ ছুটি/ আরাম/
স্বস্তির কথা ভেবে থাকলে কথাটা ভুল বুঝলেন – স্বাচ্ছন্দ্যের অন্বেষণ কনজিউমারিজমের
মিত্র নয়, প্রতিপক্ষ। বেড়াল ছাড়া আর কেউ আকাশকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারে না,
মাটিকে পারে না আকাশে ঘুড়ির মতো উড়িয়ে দিতে, যে নাচের মুদ্রায় মাটিতে-আকাশে মিলে
একাকার হয়ে যায়, বাতিল হয়ে যায় মানুষের বিত্তের আর হিসেবের ধাতব মুদ্রা।
বছর কুড়ি
আগে আমার অন্যতম গুরু রামচন্দ্র গান্ধি বলেছিলেন, “এই-যে তুমি ইংরিজিকে ভারতীয়দের
মাসির ভাষা বলে প্রতিপন্ন করে বই লিখেছ, খাসা দেখাচ্ছে তোমার গল্পটা, কিন্তু এইবার
ভাবনাটাতে আরো একটা ঠেলা মারা উচিত তোমার, নইলে সেই ঝড় উঠবে না যেটা তোমার ঝড়। শোনো,
এক কাজ করো। বেড়াল যে বাঘের মাসি এই কথাটা মাথায় রেখে, মার্জারমনস্ক চিত্তে, তুমি
এবার রাজা রাওয়ের ‘দা ক্যাট অ্যাণ্ড শেক্সপিয়র’ উপন্যাসখানা পড়ে ফেলো। তারপর দেখো
কোন্ দিকে চলতে পারছে তোমার রচনার গাড়ি। হয়ত দেখবে বইটার নতুন সংস্করণ লিখতে বসেছ
বাংলায়। দেখো না কী হয়।”
করেছিলাম
সবই। ফলপ্রাপ্তি ঘটল না; ঘটবার কথা নয় বলেই হয়তো। রাজা রাও তাঁর সুনির্মিত রচনায়
মর্কটন্যায় আর মার্জারন্যায় পাশাপাশি উত্থাপন করে উপন্যাসের খেলা সাজিয়েছেন।
বাঁদরছানা নিজে নিজেই মাকে আঁকড়ে ধরে। সেই ধরনটাকে ভারতীয় পরম্পরায় বলে
মর্কটন্যায়। আর বেড়ালছানা যেখানে পড়ে আছে সেখানেই মিউমিউ করতে থাকে। মা ঠিক খুঁজে
বের করে তাকে মাতৃস্নেহ দিতে চলে আসে। মার্জারন্যায় আর মর্কটন্যায়ের তফাতটা
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসেরও মনে ধরেছিল। এই ছবিটার পাশাপাশি ওই যে বাঘের জায়গায় ভারতীয়
ভাষাকে আর বেড়ালের ভূমিকায় ইংরিজিকে বসাতে বলা হয়েছিল সেইরকম বসিয়ে, আমার নিজের
আজগুবি বক্তব্য আর খেয়ালের খেলাটাকেও মিলিয়ে, কই তেমন করে ঝড়ের ডাক তবু শুনতে
পেলাম না তো। ছটফট করতে লাগলাম। আমি বড়ো চঞ্চল শিষ্য ছিলাম। গুরুকে বেজায় কষ্ট
দিতাম। রামুভাই বললেন, “সেদিন আসবে, প্রবাল, ঠিক আসবে। এক দিন দেখবে লোকে আমার
কথাটাও নিয়েছে, তোমার কথাটাও হজম করেছে, ওই যে তুমি বল জীবনানন্দ লিখেছিলেন ‘ভিড়ের
চরিত্র পালটে যাবে’, সেটা সত্যি হবে এক দিন। তখন আসর জমবে। সেই জমজমাট আসরে মনে
হবে এমন কোনো সময় বুঝি কখনো ছিলই না যখন কথাবার্তা জমেনি। আমরা এই যে আজ কষ্ট
পাচ্ছি এসব মিলিয়ে যাবে প্রবাল। অযথা এত আর্ত হতে দিও না নিজেকে। যথাযথ আর্তির
বিষয়গুলোকে চিনতে তো দেরিই করে ফেলছ।”
এদেশের
পুরোনো আমলের যে ঝুলিতে মর্কটন্যায় আর মার্জারন্যায়, সেই একই ঝুলিতে তাদের সঙ্গী
আরো-একটা ন্যায় – অরুন্ধতী-প্রদর্শন-ন্যায়। হরিচরণের বঙ্গীয় শব্দকোষে ‘ন্যায়’
শব্দের এলাকায় অনেকগুলো ন্যায়ের তালিকা পাওয়া যায়; সেখানে অরুন্ধতী-প্রদর্শন-ন্যায়ের
এই সংজ্ঞার্থ দেওয়া আছে: “অরুন্ধতী দেখাইবার ইচ্ছায়, তাহার নিকটস্থ স্থূল নক্ষত্র
দেখাইয়া, পরে তাহা অরুন্ধতী নহে বলিয়া প্রকৃত অরুন্ধতী দেখানো হয়। গৌণ উপদেশের
প্রত্যাখ্যান ও মুখ্য উপদেশকরণ, ইহার অভিপ্রেত বিষয়।” তা সেইসব “স্থূল” নক্ষত্রের
কোঠায় যে বশিষ্ঠও পড়ে এ খবর পাওয়া যায় ওই একই শব্দকোষে ‘অরুন্ধতী’ শব্দের তল্লাটে:
“‘অরুন্ধতীর ন্যায় পতিব্রতা হও’ এই অভিপ্রায়ে পতির সহিত নববধূকে অরুন্ধতী দেখাইবার
বিধি আছে।”
এটুকু শুনে আপনারও কৌতূহল মেটেনি ধরে নিচ্ছি। সুধীরচন্দ্র সরকার তাঁর পৌরাণিক
অভিধানে (কলকাতা: এম. সি. সরকার, ১৯২৮/১০ম সংস্করণ ২০১২) জানাচ্ছেন “অরুন্ধতী” ছিলেন
“বশিষ্ঠের পত্নী। ইনি অতীব বিদুষী ছিলেন। নিয়মিত তপশ্চর্যার ফলে এঁর আধ্যাত্মিক
শক্তি বিশেষভাবে বর্ধিত হয়েছিল। পতিভক্তি ও পাতিব্রত্যের ইনি আদর্শ ছিলেন।
মহাভারতের অনুশাসন পর্বে লিখিত আছে – পতিসেবারূপ ধর্মপথ যে নারী অনুসরণ করেন, তিনি
অরুন্ধতীর মতো স্বর্গেও পূজিতা হন। আকাশে নক্ষত্ররূপে বশিষ্ঠাদি সপ্তর্ষিমণ্ডলে
বশিষ্ঠের পাশে অরুন্ধতী বিরাজ করেন। যাঁরা সপ্তর্ষি মণ্ডলে অরুন্ধতীকে দেখতে পান
না, তাঁদের আয়ু শেষ হয়েছে বলে প্রতিপন্ন হয়। বিবাহের কুশণ্ডিকাকালে মন্ত্র
উচ্চারণের সময় নববধূকে অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখানো হয়।”
কমসেকম দুখানা মস্ত অনির্ণেয়তা বসে আছে এখানে। আয়ু শেষ বলে প্রতিপন্ন হওয়ার
কথাটা তো দেখছি স্ত্রীপুরুষনির্বিশেষে বলা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে শুধু বিবাহিত রমণীদেরই
দর্শনীয় নয় অরুন্ধতী-নক্ষত্র। তাহলে সকলেরই উচিত নিয়মিত সপ্তর্ষি নিরীক্ষণ করে
যাচাই করতে থাকা – কী, এখনও অরুন্ধতী দেখতে পাচ্ছি তো, নাকি আয়ু ফুরিয়ে এসেছে?
কিন্তু এরকম যাচাইয়ের খেলা খেলতে কোন্ গুরুর কাছে কোন্ বয়সে আমার শিক্ষানবিশি শুরু
হবার কথা সেটা তো আমাকে বলে দেওয়া হচ্ছে না, যদি না ঐতিহ্যের আর-কোথাও লুকিয়ে থাকে
সেই গোপন উপদেশ।
কথাটা শেষ হয়নি। এর চেয়েও বড়ো একটা অনির্ণেয়তা চোখে পড়ছে। পৌরাণিক অভিধানের
যথাস্থানে জানতে পারি ‘সপ্তর্ষি’র নাম “মরীচি, অত্রি, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু,
অঙ্গিরা ও বশিষ্ঠ” এবং তাঁদের যথাক্রমে “কলা, অনসূয়া, ক্ষমা, হবির্ভূ, সন্নতি,
শ্রদ্ধা ও অরুন্ধতী এই সাতজন স্ত্রী। এঁরা সকলেই লোকজননী।” ভালো কথা, কিন্তু পাঠক
অবধান করুন, সবাই তাই বলে নক্ষত্র হয়ে যাননি। যেমন অভিধানের অন্যত্র ‘শ্রদ্ধা’র
খোঁজ নিন, দেখবেন “কর্দম ঋষির কন্যা। এঁর স্বামীর নাম অঙ্গিরা”, খেল খতম, নক্ষত্র
হজম, কই শ্রদ্ধাকে তো রাতের আকাশে দেখছি না। তাহলে ধরে নেওয়া চলে, খালি
পাতিব্রত্যের রেকর্ডধারিণী অরন্ধতীই আকাশে চান্স পেয়েছেন। এবার বলি কোন্ অর্থে
তাঁর স্ট্যাটাস অনির্ণেয়। আমার প্রশ্ন হল, অরন্ধতী কি তাহলে সপ্তর্ষির প্রচ্ছন্ন
সদস্যা, ঋষি-অভিধার আর্ষপ্রয়োগবশত তিনিও কি ঋষি বলে গণনীয়া? অর্থাৎ হিসেবের ভুল
শুধরে আসলে কি সপ্তর্ষিকে অষ্টর্ষি বলা সমীচীন?
এরকম প্রশ্নের দিকে আমাকে ঠেলেছে অনেক বছর আগের একখানা রীডার্স ডাইজেস্টে
প্রকাশিত চুটকি। সেটার বয়ান ছিল এইরকম। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একজন বুরোক্র্যাট
দেখতে পেলেন একরাশ ছাগল চলেছে, সঙ্গে তাদের রাখাল। আধুনিক বাংলাতেই লিখছি, বুরোক্র্যাটকে ‘আমলা’
বললে কমবয়সি পাঠকের চিত্তে ‘ডাবর আমলা’র অনুষঙ্গ জেগে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা।
বুরোক্র্যাটটি বললেন, “আচ্ছা, আমি যদি এক কথায় বলে দিতে পারি তোমার কটা ছাগল, তুমি
কি তাহলে আমাকে একটা ছাগল দিয়ে দেবে?” রাখাল রাজি। বুরোক্র্যাট তখন এক কথায় বলে
দিলেন, “২৮৭।” রাখালের পরাজয়স্বীকার: “ঠিক আছে, বেছে নাও কোনটা নেবে।”
বুরোক্র্যাটের পুরস্কার গ্রহণ। প্রস্থানে উদ্যত। তাঁকে থামিয়ে রাখালের নতুন চাল,
“আচ্ছা এবার আমি যদি এক কথায় বলে দিতে পারি তোমার কী পেশা, তুমি কি তাহলে ফেরত
দিয়ে দেবে?” বুরোক্র্যাট রাজি। রাখালের সহাস্য ঘোষণা: “তুমি বুরোক্র্যাট।”
বুরোক্র্যাটের বিস্ফারিত বিস্ময়: “কী করে জানলে?” রাখাল: “ছাগল পাহারা দেবার
কুকুরটাকে নামাও আগে, তারপর বলছি।”
হাসি থামার আগেই একটা খটকা লেগেছিল আমার: ঠিক কটা ছাগল চরানো হচ্ছিল সেদিন? হয়
২৮৬ (মানে আমলাটি ভুল করে কুকুরকেও ধরেছেন বলে ২৮৭ বলেছেন, সেক্ষেত্রে ওঁর ওই
সংখ্যা তো রাখালের এক কথায় মেনে নেবার কথা নয়); নয়তো ২৮৭ (সেক্ষেত্রে দাঁড়াচ্ছে
কুকুরের সঙ্গে ছাগলের তফাতটা এমনকি আমলার স্থূল দৃষ্টিতেও ধরা পড়ে, কিন্তু তাহলে
তিনি কুকুরকে বেছে নেবেন কেন)। গল্পটাতে একটা অসংগতি শুধু যে বসে আছে তাই নয়, ওটা
না থাকলে গল্পটা বলাই যেত না। হাসতে পারি আমরা অসংগতিটা লক্ষ করি না বলে। এভাবে
ভাবলে দেখা যায় চুটকিটার গভীরতা – ঘাইহরিণীর সঙ্গে মিল থাকুক বা না থাকুক, ওই
বুরোক্র্যাটের মতো আমরা সবাই, আমরা যারা এই চুটকি শুনে হাসছি।
দাঁড়াচ্ছে যে অরুন্ধতীকে বাদ দিলেও সপ্তর্ষির গোটা খেলাটা ঠিকমতো জমছে না ওই নক্ষত্রসপ্তকের,
আবার দস্তুরমতো মেম্বারশিপ আছে ধরে নিলেও তারার সংখ্যানির্ণয়ে অন্য বিপত্তি এসে
পড়ে, কারণ বশিষ্ঠের উজ্জ্বল উপস্থিতির সামীপ্যেই অরুন্ধতী দৃষ্টিগোচর হয়ে ওঠেন এই জায়গাটুকু
যথেষ্ট ঝাপসা না থাকলে গল্পটা ঠিকমতো জমতে গিয়েও জমে না। অর্থাৎ সপ্তর্ষিতে
অরুন্ধতী আছেনও বটে আবার নেইও বটে, এইরকম একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারা জরুরি।
কিন্তু বেশি পরিষ্কার করে সেকথা বলাও আবার চলবে না, কারণ ওই যে বললাম, ছবির ওই
জায়গাটাকে ঝাপসা না রাখলে নান্দনিক অসুবিধে।
পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছ আমি লিঙ্গ নিয়েই কথা বলব ঠিক করেছি; তাই তুমিও নিশ্চয়ই
লিঙ্গ নিয়ে রাজ্যের যত দুশ্চিন্তা আবার খুঁচিয়ে তুলছ নিজের মনে; ভাবছ, সেভাবে আমার
এইসব কথার তালে খানিকটা তাল মেলাও না মেলাও অন্তত আমার দুয়েকটা ভুলচুক দেখতে পাবে।
ভালোই করছ। পড়তে গিয়ে আমরা অনেকেই তো লেখকের সঙ্গে এইভাবে পাঞ্জা লড়ার বা অন্তত
ছিদ্রান্বেষণের খেলা খেলেই থাকি। বেশ করি। নইলে সময় কাটত কী করে বলো তো, পাঠক?
কিন্তু এবার তুমি নড়ে চড়ে বসেছ। লক্ষ করছ হঠাৎ আপনি-আজ্ঞে সম্বোধন বন্ধ করে আমি
তুমি-সম্বোধনে নেমে এসেছি। তাই ভাবছ, এবার কি তাহলে তুইতোকারির দিকে এগিয়ে চলেছে
এই প্রবন্ধের সম্ভাষণরীতি? ব্যাপারটা কী? কথা হচ্ছিল লিঙ্গ নিয়ে। অকস্মাৎ সর্বনাম
নিয়ে টানাটানির তাগিদ এল কোত্থেকে?
আমার মনে হয়েছিল তোমার নিজের মর্যাদা নিয়ে টানাটানি না করলে তুমি দেখতে না
পেতেই পারো যে সর্বনামের প্রশ্ন আগেই তুলেছি। সেইজন্যেই চোখে আঙুল দেওয়া এই
টানাটানির আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম। বেয়াদপি মাফ কোরো যদি তোমার প্রতি অবিচার করে
থাকি। কয়েক প্যারা পিছিয়ে গিয়ে আরেকবার পড়ে দেখো আমলার সঙ্গে রাখালের কথোপকথন।
এবার তো তোমার চোখ খুলে গেছে। আশা করি দেখতে পাবে, আমলাকে সমীহ না করে রাখাল
তুমি-সম্বোধন করছে বলে দেখিয়েছি বটে, কিন্তু যে-আমি গল্প বলছি সেই আখ্যায়ক-আমি রাখালকে
ওই চুটকির বয়ানে একবারও ‘তিনি’ বলিনি, ‘সে’ বলিনি। গৌরব নির্দেশ এড়িয়ে এড়িয়ে পুরো
গল্পটা বলেছি। এই অনির্ণেয়তা নজিরবিহীন নয়। শ্যামদেশের ওরফে থাইল্যাণ্ডের সমাজে
গৌরব নির্দেশ নিয়ে প্রচুর আঁকা বাঁকা নিয়ম আছে, কোনো কোনো অবস্থায় কিছুতেই ঠিক করা
যায় না বিশেষ একজনকে কীরকম উল্লেখ করা সমীচীন, তিনি-পর্যায়ে না সে-পর্যায়ে। তখন
সবাই উল্লেখ উহ্য রেখে প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। ওরকম এড়িয়ে যাওয়াটাই ওই প্রশ্নের
স্বীকৃত উত্তর। এই পরিহার-রীতির পরিস্ফুট বিবরণ দিয়েছিলেন থাই ভাষার এক বিশেষজ্ঞ
উনআশি সালের এক সেমিনারে। তাঁর নিবন্ধের নাম রেখেছিলেন ‘অ্যাংজাইটি অ্যাণ্ড
অ্যান্যাফরা ইন থাই’।
পণ্ডিতি প্রবন্ধের দুনিয়া অবশ্য এ আলোচনার একমাত্র অকুস্থল নয়। এড়িয়ে যাওয়ার
এই ধরনটাকে শনাক্ত করা দু-তিন প্রজন্ম আগে আমাদের সমাজে অপণ্ডিতদের পক্ষেও সহজ ছিল।
যার সঙ্গে কথা হচ্ছে সে যদি বক্তার চেয়ে বয়সে ছোটো হয়, অথচ তাকে ‘তুমি’ বলা উচিত
কিনা সে বিষয়ে কোনো কারণে বক্তার যদি অস্বস্তি বা সংশয় থাকে, তাহলে মুষ্টিমেয় কোনো
কোনো বাঙালি মাঝে-মাঝে আজও বলেন – একদা অনেক বাঙালি ঘন ঘন বলতেন – “কোথায় যাওয়া
হচ্ছে?”, “কোন্ ক্লাসে পড়া হয়?” সম্বোধন সমস্যার এই ভাববাচ্য-ভিত্তিক সমাধানটা
নিয়ে সেই যুগে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে দেখেছি অনেককে।
প্রিয় পাঠক, তোমার অধৈর্য যে চরমে পৌঁছেছে এটা আমার নজর এড়ায়নি। তুমি ভাবছ,
আমি অরুন্ধতী নক্ষত্রের অনির্ণেয়তার সঙ্গে ক্ষীণ তুলনীয়তার সূত্রে কোথা থেকে যেন
ছাগল-কুকুর-আমলা-রাখালের গল্পের খেই ধরে ‘সে’ বনাম ‘তিনি’ কিংবা ‘তুমি’ বনাম
‘আপনি’র বিষয়টাকে হিড়হিড় করে টেনে আনলাম, সেই থেকে আসল বিষয় ছেড়ে এই চিত্তবিক্ষেপে
আচ্ছন্ন রেখেছি তোমার মতো সিরিয়াস পাঠককেও। তাই সমানে বেড়ে চলেছে তোমার বিরক্তি।
ভেবে রেখেছ, খানিক বাদে আমি নিশ্চয়ই বলে উঠব, “দেখেছ, টপিকটা গুলিয়ে দিলাম, হি হি,
আমি কীরকম পোস্টমডার্ন”, আর তখন তুমি গম্ভীর মুখে আমাকে জানাবে, একটা খেলা শুরু
করতে করতে ভেস্তে দিলেই সেটা কিছু পোস্টমডার্নিটির পরাকাষ্ঠা হয়ে যায় না, আমি
তোমাকে হতাশ করেছি, এবার তুমি সত্যিকারের বিশারদবৃন্দের কাছে শিখতে যাচ্ছ ঠিক কী
ধরনের প্রমাণ দাখিল করলে আমার এই ফাঁকিবাজিতে যে অধুনান্তিকের ছিটেফোঁটাও নেই সে
কথা তুমি সব্বাইকে ষোলো আনা বুঝিয়ে দিতে পারবে।
তুমি আসলে ভুলে গেছ, অথবা জানো না, যে লিঙ্গ নিয়ে বাংলায় কথা বলতে চাইলে এমনসব
দৃষ্টান্তের দিকেই তাকাতে হয় যেখানে আমাদের ভাষার শব্দের স্তরে লিঙ্গের উনিশ-বিশের
খেলা দেখা যাচ্ছে। ইংরিজির মতো হী থেকে শী-কে আলাদা করা, কিংবা হিন্দির ধরনে উও
আয়েগা থেকে উও আয়েগী-র পার্থক্য প্রকাশ, বাংলার স্বভাববিরুদ্ধ। স্ত্রীপুরুষনির্বিশেষে
আমরা এ-ও-সে বলে থাকি। কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিকেরা অনেক দিন ধরেই বলাবলি করে আসছে,
তুচ্ছ গৌরব বিদ্ধ তুই আর মধ্যম গৌরব চিহ্নিত তুমির সঙ্গে উচ্চ গৌরব বিশিষ্ট আপনির
তফাতটা বাংলায় প্রায় লিঙ্গভেদের মতোই। পণ্ডিতমহলের বাইরের দুনিয়াতেও দেখা যায়, একাধিক
ভাষায় যখন আধুনিক মানুষ লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিগ্রাহ্য বিগ্রহপূজার মানসে
সর্বনামের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রকাশ্য পরিসরে নাড়াচাড়া করতে লাগল মোটামুটি সেই সময়
নাগাদ বাংলায় সেই হাওয়া এসে লাগল গৌরবের হেরফেরের জায়গাটাতে। নইলে আজ কেন এফ এম
রেডিওর অ্যাঙ্কর মুখ-না-চেনা শ্রোতাকে মুড়ি-মিছরির এক দরের সাধারণ্যে এনে ‘তুমি’
সম্বোধন করবে?
ঠাস করে কথাটা বলে ফেললেই বিষয়টা উত্থাপন করা হল বলে ভাবা চলবে না। একটু রয়ে
সয়ে ভাবতে হবে, ঠিক কী বলা হচ্ছে, কথাটা দাঁড়াচ্ছে কিনা, হয়তো জরুরি কিছু বাদ পড়ে
যাচ্ছে। এর সঙ্গে কি স্ত্রীপুরুষ ভেদবুদ্ধির কোনো সম্পর্কই নেই? তাহলে কেন দেখতে
পাই গৌরব-বিদ্ধ সর্বনামতন্ত্রে বহু সমাজেই বাচ্চারা বাবাকে আপনি আর মাকে তুমি বলে,
কিংবা বাবাকে তুমি আর মাকে তুই? বাঙালিদের সামাজিক আচরণের চৌহদ্দিটুকুই যদি ধরি
তাহলেও, সাবালক পুরুষরা যে বৃত্তে পরস্পরকে এমনিতে আপনি বলতে অভ্যস্ত সেইসব
বৃত্তেও কেন বড়ো হয়ে যাওয়া মহিলারা তুমি দিয়েই সম্পর্কের সূত্রপাত করে আসছে বেশ
কয়েক প্রজন্ম ধরে, সর্বনামের অভ্যেস-বদলের সাম্প্রতিক তরঙ্গের অনেক আগে থেকে?
বিদগ্ধ পাঠক, তুমি এবার রীতিমতো রেগে যাচ্ছ। তোমার দৃঢ় বিশ্বাস আমি ফালতু কথা
বলছি। ঠিক আছে, তুমি এবার নিজেই আসরে নেমে সেই কথা তোলো যা তোমার মতে কাজের কথা। একটু
দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটেই বলো না, সেই যে বঙ্কিমচন্দ্র পাঠককে অবলীলাক্রমে ‘তুমি’
সম্বোধন করতেন, কেউ তো রা কাড়ত না, সেই বেদাগ সম্বোধনের রীতি বন্ধ হল কী করে? কোন্
গোষ্ঠির হস্তক্ষেপের ফলে ‘তুমি’-র প্রয়োগের গায়ে খড়ির দাগ লেগে গেল, “সাবধান, এই
সর্বনাম ব্যবহার করা মানেই বিশেষ বৈয়ক্তিক নৈকট্য”? ব্যাপারটা কি ব্রাহ্ময়ানার
ইতিহাসের অন্তর্গত? আমি কুইজের প্রশ্ন ছুঁড়ে মারছি না, বিশ্বাস করো, উত্তর জানি
না, তোমার কাছেই জানতে চাইছি।
এভাবে লিঙ্গের বিষয়টাকে কেন চেপে ধরা, সে কথাও তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইতে পারো।
আসলে হয়েছে কী, আধুনিক কবিতা বলতে আমরা অনেকে যা বুঝি, সেই শিল্পধারার গোড়ার
দিককার কর্মী শার্ল বোদলেয়ারের রচনার সূত্রে প্রসঙ্গটা উঠে এসেছিল। বেড়ালের সঙ্গে
যৌন দ্বিকল্পনের মেরুকৃত জগতে নারীর সারূপ্য দেখতে পেয়েছিলেন বোদলেয়ারের
‘বিড়ালেরা’ কবিতার ভাষ্যকার লেভি-স্ত্রোস আর ইয়াকবসন, যাঁরা কবিতাভাষ্যের
সোস্যুরীয়-ভাষাতত্ত্ব-নির্ভর গ্রন্থনবাদী রীতির প্রবক্তা। সেইসব কথার খেই ধরব
এবার, যাতে বোঝা যায় লিঙ্গের বিষয়টা কোন্ পথ দিয়ে চলে এল কবিতা আর বেড়ালের এই
সংলাপে।
বুদ্ধদেবের সুপরিচিত অনুবাদে বোদলেয়ারের ‘লে শা’ কবিতার বাংলা চেহারাটা এইরকম:
বিড়ালেরা
প্রৌঢ় ঋতুর আগমে, প্রণয় জানায় তাকে
উগ্র প্রেমিক, শীর্ণ কঠিন
পণ্ডিতেরা –
নিকেতনমণি বিড়াল – দৃপ্ত কোমলে
ঘেরা –
তাদেরই মতো সে, ঠাণ্ডার ভয়ে, ঘরেই
থাকে।
জ্ঞানের, কামের সেতুবন্ধনে উদার
বোধি,
খোঁজে সে বিজন, স্তব্ধ ভীষণ
অন্ধকার;
শবযাত্রায় অশ্ব হ’তো সে চমৎকার
এরেবস্ তার গর্ব ভাঙতে পারতো যদি!
স্ফিঙ্কসের মতো, নির্জনতার অঙ্কে
লীন,
আলসে এলিয়ে স্বপ্ন দ্যাখে সে
অন্তহীন
ভাবের আবেশে মগ্ন মহান ভঙ্গিমায়,
উর্বর কটি, মায়াবী মন্ত্রে ফুলকি ছড়ায়,
এবং সূক্ষ্ম বালুর মতন রঙ্গিমায়
সোনার কণায় তারা জ্ব’লে ওঠে চোখের
তারায়।
(শার্ল বোদলেয়ার / তাঁর কবিতা/ অনুবাদ, ভূমিকা, টীকা,
কালপঞ্জি ও জীবনীপঞ্জি: বুদ্ধদেব বসু/ কলকাতা: দে’জ, ১৯৮১, পৃ ৮৮; এ কবিতাটি ওই
সংকলনভুক্ত ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’-এর অর্থাৎ ‘ক্লেদজ কুসুম’-এর অন্তর্গত)
কবিতার
গ্রন্থনবাদী ভাষ্যের রীতিনীতির সঙ্গে বিশ শতকের প্রথমার্ধের ভাষাতত্ত্বের
আত্মীয়তার যে জট সেসব ছাড়াতে বসিনি এখানে। লেভি-স্ত্রোস আর ইয়াকবসন যা লিখেছেন (ক্লোদ
লেভি-স্ত্রোস আর রোমান ইয়াকবসন, “শার্ল বোদলেয়ার’স ‘লে শা’”, রিচার্ড আর ফেরনান্দ
দ্যঝর্ঝ সম্পাদিত ‘দা স্ট্রাকচারালিস্টস ফ্রম মার্কস টু লেভি-স্ত্রোস’ সংকলনভুক্ত,
নিউ ইয়র্ক: অ্যাঙ্কর, ১৯৭৭, পৃ ১২৫-১৪৬) তা থেকে এই সিদ্ধান্তটুকুই তুলে নেব যে
“ফর বোদলেয়ার, দি ইমেজ অভ দা ক্যাট ইজ লিঙ্কড টু দ্যাট অভ দা উওম্যন” (১৪৫)।
আধুনিকবাদী
কাব্যবীক্ষারও যেখানে মুশকিল, গ্রন্থনবাদী তত্ত্বের দেখতে না পাওয়ার জায়গাটা সেই
একই তল্লাটে। ওঁদের চোখের নজর সাংঘাতিক ভালো – কিন্তু লক্ষ করেননি যে সেই তাকানোর
দিকেও তাকাতে হয়। এই যে এত পাতা জুড়ে লেভি-স্ত্রোস আর ইয়াকবসন মনোযোগ সহকারে
দেখলেন আর দেখালেন কবিতার কোন্ চরণে কোন্ লিঙ্গের কড়ি বা কোমল পায়ের চিহ্ন, ওঁদের
কাজের এই ধরনটার যেসব সেরা উদাহরণ সেগুলোতেও কিছুতেই ফুটে ওঠে না প্রদর্শক-আমির
সঙ্গে পুরুষপক্ষের সাযুজ্য আর নারীপক্ষের বৈযুজ্য। প্রদর্শনের ভেলকির খেলাটা
যেভাবে খেলে সেই ভোজবাজির একটা নান্দনিক শর্ত এই – কোনো মুহূর্তেই, কোনো দৃষ্টিকোণ
থেকেই, প্রদর্শককে পাঠক দেখতে পাবেন না। দৃষ্ট পুংবিম্ব আর দৃষ্টা স্ত্রীবিম্ব, এ
দুই বিম্বের মধ্যে স্ট্রিক্ট নিউট্র্যালিটি ওরফে কড়া নিরপেক্ষতার রক্ষক নিজেকে
ফিল্মের প্রোজেকশন কক্ষের মিস্ত্রির ভূমিকায়, প্রদর্শকের ভূমিকায় নিয়োজিত রাখে,
আলোকিত প্রেক্ষাগৃহের পিছনে।
ফলে আমরা
যারা দর্শক তারা লক্ষ করতে ভুলে যাই যে পুরুষের কড়ি আর নারীর কোমল সেটিঙের মধ্যে
‘কড়ি’র সঙ্গেই ওই ‘কড়া’ নিরপেক্ষতার সুর চুপিচুপি মিলে যায়।
সেই ভুল
যখন ভাঙে তখন ক্রমশ বুঝতে শিখি, কড়া নজর রাখা যথেষ্ট নয়, কড়া নজরের উপরেও কোমল নজর
রাখার কায়দা ক্রমশ আয়ত্ত করতে হবে, সেই শিক্ষানবিশিতে সাবেক কালের গুরুবাদের সুরে
সুরেলা কোনো গুরু জুটবে না। এই কথাটা বুঝতে আমি শিখেছিলাম রামুভাইয়ের, অদ্বৈতবাদের
নতুন ভাষ্যকার রামচন্দ্র গান্ধির, সৎসঙ্গে। তিনি গুরুও ছিলেন, নিজেকে সর্বত্র
সর্বদা লঘু করতেও জানতেন, লঘু করার ফলে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন তবু এই কঠিন-কোমল
সাধনারীতিকে ত্যাগ করেননি।
তাঁর সাহচর্যে কী দেখতে শিখেছি তার কোনো বারোয়ারি নিত্যকর্মে নিশ্চিন্তে
ব্যবহার্য যে সারসংক্ষেপ হয় না একথা জেনেও তবু একটা কিছু তো তোমার সামনে দাখিল
করতেই চাইছি। নইলে এতক্ষণ তোমায় বসিয়ে রাখাটা বিশুদ্ধ অসভ্যতার শামিল। তিনি আমায়
বুঝতে সাহায্য করেছিলেন, অদ্বৈত বলতে একটা জায়গার বা একটা কেন্দ্রের নিজেকে নিয়ে
মত্ততায় বিভোর হয়ে থাকা বোঝায় না – ওই স্বাধিকারপ্রমত্ত রীতিটা ক্ষমতার
আত্মবিস্মৃত আত্মভাষ্য। অদ্বৈত মানে ভেদবুদ্ধি কাটিয়ে উঠতে শেখা; কথাবার্তায় আমি
যতক্ষণ তোমার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে পারছি, যতক্ষণ তোমাকে নিতান্তই পর ভেবে সরিয়ে দিচ্ছি
না, ততক্ষণ প্রাণের মেলা চলছে, ওই সাবলীল মেলাটাই ভেদবুদ্ধি অতিক্রম করতে থাকার
জায়গা। সেই জায়গার এক দিকে আমি আর অন্য দিকে আমার সম্বোধিত ‘তুমি’, এই মেরুজ্ঞানটা
ভুলে যেতে আমায় কেউ বলছে না – ভুলে গেলে আমি মেরুকৃত দ্বিকল্পনকে অতিক্রম করার যে
কাজটা করছিলাম সেই প্রক্রিয়াটা যাবে থেমে, সে বিরতি তো অদ্বৈতের বিজয়গাথা গাইবার
মুহূর্ত নয়, সেটা আমার নিচু গলায় “ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু” গাইতে থাকার ধূসর
সময়। আমি মনে মনে নিজের সেই পথশ্রান্তিকে যদি স্বীকৃতি দিতে পারি তাহলে বুঝব
ফুরিয়ে যায়নি আমার মনের জোর, থেমেও থেমে যায়নি আমার অদ্বৈতের পথ চলা। সেই স্বীকৃতি
দেবার কাজে আমার গুরু জীবনানন্দ দাশ, যিনি ধূসরের কুয়াশাতেও কবিতার বিমানের অনায়াস
টেকঅফ আর ল্যাণ্ডিংএর কুশলী পাইলট, যাঁর হাতে তাই পালটে গেছে কবিতার কাজের মূল
জায়গা।
“তার মানে কি কোনো একটা কেন্দ্রের বদলে কোনো দুজনের
নিভৃত কূজনের, নিরিবিলি প্রাণের আলাপের এলিটিজমের দিকেই ঝুঁকে যেতে বলা হচ্ছে?”
সম্বোধন যখন ঘটে, তখন সম্বোধক আর সম্বোধিত এই দু পক্ষের দ্বিত্বটা সেই সম্বোধন-ঘটনা-সঞ্জাত
দ্বিত্ব। ওই দ্বিত্ব থেকে পালাতে চেষ্টা করা পণ্ডশ্রম। কথাবার্তায় যখন সংযুক্ত
থাকছ তখনকার সংযুক্তির ওইটাই চেহারা। তুমি যদি দরজা খোলা রাখতে শিখে থাকো তাহলে
অনায়াসে অন্যান্য সম্বোধক, অন্যান্য সম্বোধিত যখন ইচ্ছে জুটে যাবে ওই মেলায়, সবার হিয়ায়
চলবে রসের খেলা – মুহূর্ত মোতাবেক বিবিধ রসের। তোমার ইনক্লুসিভ পলিটিক্স তোমাকে
সেই অন্তর্ভুক্তির পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারবে না, কারণ তার ভিত্তিটা আধুনিকবাদের
ভেদবুদ্ধিতে আচ্ছন্ন।
অদ্বৈতের সুরে বাঁধা অধুনান্তিক রীতি দ্বিকল্পনের বাস্তব মেরুকরণ থেকে পালিয়ে
না গিয়ে তার চোখে চোখ রেখে, একবার স্নিগ্ধ একবার কঠিন চাহনির মধ্যে যাতায়াত
অব্যাহত রেখে, পর পর দরজা খুলতে থাকে। আর আধুনিকবাদ দ্বিকল্পন থেকে দ্বিকল্পনে
উত্তীর্ণ হতেই শিখেছে বলে তরজার পর তরজা সাজিয়ে চলে। ফালতু পি.জে. করে তোমাকে
উত্তেজিত রাখছি যাতে এর পরের পি.জে.টা দেখে একেবারে মূর্ছা যাও।
কিছু কাল আগে ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ বলে একটা প্রসঙ্গ ফেঁদেছিলাম। সেই
সূত্রে ভেবে বলো তো, তুমি যখন আধুনিক বিজ্ঞানের দূরবীক্ষণ আর অণুবীক্ষণ দিয়ে দূরের
মহতো মহীয়ান্ আর কাছের অণোর্ অণীয়ান্ জিনিসপত্রকে যথাক্রমে কাছে টেনে আনো এবং
বাড়িয়ে মাঝারি আয়তনে নিয়ে আসো যাতে তোমার নজরে তাকে ধরতে পারো, তখন তুমি আদতে কী
করছ? আমি বলে দিই? জিনিসটাকে তুমি তোমার বাগে আনছ, যাতে তোমার পছন্দমতো
ম্যাগনিফিকেশনে দেখতে পাও।
বাগ, ইয়ানী বগীচা, ওই বাগান আর কী। তোমার সাজানো বাগানে নিয়ে আসতে পারলে তবে
তুমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলো, এইবার ধরতে পেরেছি।
নীটশে যখন পাগল হয়ে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময় দিয়ে, যতদূর মনে পড়ছে ১৮৮৯ সালে, একজন
প্রখ্যাত নীটশেবিদ পণ্ডিতকে চিঠি লিখে বলেন, “আমাকে তুমি ধরতে পেরেছ ভালো করেই
জানি। খুব ভালো ধরেছ। এবার আমায় ছাড়তে পারবে কি? ছেড়ে দেখাও তো?”
অধুনান্তিক শেখাটা ওই ছাড়তে শেখার দস্তুর। বাগে আনা কথাটার ব্যুৎপত্তি যাঁরা
জানেন তাঁরা ভুল ধরিয়ে দেবেন, সেই অপেক্ষায় আছি, পাঠক তুমি তখন ধরতে পারবে আসল
উত্তরটা কী হবার কথা, আমি আগাম বলে রাখছি, তার পর ভুলে যেও না উত্তরটা ধরতে পারার
পর ছাড়তে পারাও চাই, নইলে তোমার সঙ্গে আকাশের সংযুক্তি ছিঁড়ে যাবে, পড়ে থাকবে খালি
আধুনিকবাদের যুক্তি, দেখবে যে মাটির সঙ্গে একেবারেই আকাশের কোনো যোগ নেই তাকে আর
মাটি বলে চিনতেই পারছ না, মনে হচ্ছে ছাই।
ছাইও ধূসর; তবে ঠিক সেই ধূসরের গান গাইতে আমরা শিখি না জীবনানন্দের কাছে। আমার
মতো বিটকেল পি.জে. প্রণয়ন না করেও যাঁরা সেই শিক্ষার সঙ্গে তোমাকে যুক্ত করে
স্যাটিসফ্যাকশন দিতে পারেন, বুঝলে পাঠক, তুমি তাঁদের সঙ্গেই সময় কাটিয়ো এবার।
তারপর তোমার নিজের মতো করে হয়তো বুঝতে পারবে, সমীর রায়চৌধুরী আর রুদ্র কিংশুকের বই
থেকে এক বাণ্ডিল কোটেশন না ঝেড়েও আমি যে তাঁদের সঙ্গেই কথাবার্তায় যুক্ত ছিলাম এ
যাত্রা, তার প্রমাণ এই বয়ানের কোন্ কোন্ জায়গায় পাওয়া যাবে। যদি না পারো, ধরে নিয়ো
আমি ভুল করছি, সবটাই প্রলাপ। ও, তুমি উঠছ, তেতো স্বাদ মুখে নিয়েই উঠে যাবে? আরে,
একটু দু সেকেণ্ড বসে যাও, আমার চেয়ে রসাল একজন লেখকের রচনা খাইয়ে দিচ্ছি, তারপর
যেয়ো, এটা আরেক রকম বাগানের গল্পের বঙ্গানুবাদ:
“সবুজ তারা বলে কিছু হয় না
“ও প্রলাপ বকছিল:
“ – মৃত্যুকে ভয় কেন করব, আমি তো তোমাকে দেখতে পাব, সেটা থামবে না।
“সে কাঁদতে কাঁদতে তার কপালে হাত বুলিয়ে দিল।
“ও বকেই চলল:
“ – আমি তারা হয়ে যাব।
“ – তারা – সে বলল, কথাটার প্রতিধ্বনি করে।
“ – আমি তারা হয়ে যাব, ও কিছুতেই ছাড়ল না কথাটা – প্রত্যেক রাত্রে তোমার ঘুমের
প্রহরী হয়ে থাকব আমি।
“ – তারা – আবার বলল সে, প্রতিধ্বনিতে মিশে ছিল অস্বস্তি।
“ – তুমি জানলায় এসে দাঁড়ালেই আমি তোমায় দেখতে পাব।
“তারা। তাহলে অত তারার মধ্যে তোমায় কী করে চিনে নেব,” যেই না ভাবা, অমনি ও যেন
তার চিন্তা শুনতে পেয়েছে এমনভাবে ফিসফিস করে বলল:
“ – যুগ্ম তারা।
“ – যুগ্ম তারা... – আবছা গলায় বলে উঠল সে।
“ – হ্যাঁ। সবুজ – বলেই ও মারা গেল।
“রোজ রাত্তিরবেলায়, অসীম ধৈর্য সহকারে, সে আকাশে তাকিয়ে তাকিয়ে খোঁজে, যদিও এক
যুগ আগে সে জেনে গেছে সবুজ তারা বলে কিছু হয় না। প্রত্যেক রাত্রে, কখনও বাদ যায়
না, বাগানে, বনগোলাপগাছের নিচে, ছোটো একটা কালো বেড়াল চুপ করে বসে থাকে, সে জানলায়
এসে দাঁড়াবে বলে, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে জানলার দিকে একজোড়া বিস্ফারিত নেত্রে,
উজ্জ্বল সবুজ চোখে।”
লেখকের নাম লিভেন দেক। গল্পটা এসপেরান্তো ভাষায় লেখা, ‘নে একজিস্তাস ভেরদাই
স্তেলোই’ সংকলনের নামগল্প (নিউ ইয়র্ক: মোন্দিয়াল, ২০১২)। সবুজ-তারা-বিশিষ্ট এক
পতাকা এসপেরান্তো আন্দোলনের প্রতীক। গল্পের দুটো পাদটীকা দিয়েছেন লেখক: (১) স্পেনের
৫৯তম এসপেরান্তো সম্মেলনে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেভিড গালাদি-র বক্তৃতার শিরোনাম ছিল
‘সবুজ তারা বলে কিছু হয় না’; (২) জানলা থেকে আমরা যেগুলোকে দেখে একটা তারা ভাবি
সেগুলো কিন্তু বেশির ভাগই যুগ্ম তারা। পুরুষকে ‘ও’ আর মহিলাকে ‘সে’ দিয়ে চিহ্নিত
করা দেখে তুমি নিজে নিজে যা ভাবছ তার চেয়ে বেশি বিশেষ কিছুই বলতে চাইনি। নির্বিশেষ
দরবার যা বলবে সেটাই শেষ কথা; “তুমি যা অলস হাতে ফেলে দাও, কানাকড়ি মূল্য নেই
তার...”
Labels: aktuala blogero / current posting, recenzo / book review