বাক্যে বিভক্তির বন্দোবস্ত
এক
বাংলা আর পাঁচটা ভাষার মতো নয়। তার
এক দিকে রয়েছে হিন্দির মতো বিভক্তিপ্রধান ভাষা। অন্য দিকে পাচ্ছি বোরো কিংবা
মেইতেই (ওরফে মণিপুরি) ভাষার মতো প্রতিবেশী, যার গায়ে বিভক্তির বালাই নেই –
বাক্যের সংস্থান একেবারে অন্যরকম। মাঝামাঝি কিছু একটা করতে গিয়েই বাংলা কীরকম যেন
আমতা-আমতা করে। তাই বাংলা সত্যিসত্যিই কতটা বিভক্তিনিষ্ঠ তা নিয়ে রীতিমতো শক্ত প্রশ্ন
তুলে ফেলতে যেকেউ পারে, পয়সা লাগে না।
“আমি রামকে আর শ্যামকে চিনি” এরকম বাক্য দেখলে আপনি হয়তো ধরে নেন যে “রামকে”
পদের গায়ে “-কে” বলে একটা বিভক্তি আছে। তাই ধরে নিন না। কিন্তু এবার বলুন তো, একই
বাক্যের রকমফের “আমি রাম আর শ্যামকে চিনি” বাক্যে “রাম” পদের গায়ে তাহলে কী
বিভক্তি? আপনি কি শূন্য বিভক্তি বললেন? ভাল কথা, তারপর জিগেস করব, আচ্ছা “রাম
আমাকে চেনে” বাক্যে রামের গায়ে যে শূন্য বিভক্তি সেইটা কি এই শূন্যের সমান? তাই
যদি হবে তাহলে “ওরা আমাকে আর তোমাকে চেনে”-র মতো বাক্যে লোকে “আমাকে”-র “কে”-টাকে
উড়িয়ে দিয়ে তার জায়গায় কেনই বা ওই শূন্যটা বসিয়ে বাক্যটার রকমফের হিসেবে “ওরা আমি
আর তোমাকে চেনে” বলতে পারে না? এই শেষের বাক্যটা যে একেবারে অচল, এটার কারণ কী?
“আমি” পদটা সবসময় তথাকথিত প্রথমা টাইপের শূন্য বিভক্তিধারী বলে যদি ধরে নিই,
আর “আমাকে” পদটা যদি ততটাই নিষ্ঠার সঙ্গে তথাকথিত দ্বিতীয়া টাইপের “-কে”-বিভক্তি
ধারণ করতে বাধ্য হয় – এ দুয়ের মাঝামাঝি কোনো ‘মনে মনে দ্বিতীয়া কিন্তু বাইরের
চেহারায় প্রথমা’ গোছের ভূমিকায় নামা যদি “আমি” পদের বেলায় অসম্ভব হয় – তাহলে কিসের
জোরে “রামকে আর শ্যামকে” না বলে সংক্ষেপে “রাম আর শ্যামকে” বলার অনুমতি দিচ্ছে
বাংলা ভাষা ওই ন্যাড়া “রাম” পদটাকে? দেখতে কি পাচ্ছেন না “রাম আর শ্যামকে” বললে
এখানকার “রাম” আসলে চেহারায় প্রথমা কিন্তু ক্রিয়াপদের সঙ্গে সম্পর্কের বিচারে
দ্বিতীয়া টাইপের? এও কি জানেন না যে “রাম আর শ্যামকে” কেন হয়, “আমি আর তোমাকে” কেন
হয় না, এই প্রশ্নের উত্তর বাংলার কোনো ব্যাকরণে আজও নেই?
প্রশ্নটা শুনতেই সোজা। আসলে এই কথাটা নিয়ে চেপে ধরলে বাংলা ভাষার চরিত্রের
ইতস্ততর জায়গাটাতে টান পড়ে। বাংলা যদি হিন্দির মতো হত তাহলে এক দিকে হেলত, যদি
মেইতেইয়ের মতো হত তাহলে হেলত তার উলটো দিকে। না ঘরকা না ঘাটকা, তাই এই দোলাচল, যার
ব্যাকরণ লিখে উঠতে আমরা আজও পারি নি। আমাদের অজ্ঞতার কথাটা ফাঁস করে দিলাম। তরুণ
কোনো পাঠক হয়তো এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে আমাদের সবার ধন্যবাদ অর্জন করে
বিষয়টাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
শক্ত প্রশ্ন তুলে আপনাদের আহ্বান জানানো একরকম কাজ। কিন্তু যে কথাগুলো আমরা
খানিকটা ধরতে পেরেছি তার হিসেবও তো এমনভাবে দাখিল করা দরকার যা আপনাদের কাজে
লাগবে। আখের গোছানোর প্রসঙ্গ যখন উঁকি ঝুঁকি মারছেই, প্রতিবেশী ভাষা হিন্দির নামও
যখন করে ফেলেছি, তখন আসুন, একটু হিন্দি নিয়েই দস্তুরমতো কথা বলে নিই না, যাঁরা
আখের গোছাতে সত্যিই চান তাঁরা তো অনেকে হিন্দি শিখতেও আগ্রহী।
যে লোকের মাতৃভাষা বাংলা তার পক্ষে যে হিন্দি শেখা অপেক্ষাকৃত কঠিন তার অন্যতম
কারণ হিন্দি ব্যাকরণের দুটো বৈশিষ্ট্য। একটা হল আভিধানিক লিঙ্গভেদ – শব্দের এমন
লিঙ্গভেদ যা অভিধান দেখে জেনে নিতে হয়, যেমন পুংলিঙ্গ “গ্রন্থ” বনাম স্ত্রীলিঙ্গ
“পুস্তক” – “গ্রন্থ অচ্ছা হৈ” অথচ “পুস্তক অচ্ছী হৈ” (উচ্চারণ মাফিক “হ্যায়” না
লিখে বরং মূল বানান অনুসরণ করে “হৈ”-ই লিখছি, হিন্দির বানানরীতি তো অনেকেরই চেনা)।
হিন্দি ভাষার অন্য যে বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে গিয়ে বাঙালি শিক্ষার্থী
হোঁচট খায় সেটা হল অতীতাদি কালে ‘নে’ বিভক্তির ব্যবহার।
লিঙ্গ নিয়ে কিছু করবার নেই – মুখস্ত বিদ্যের বোঝাটা একটু ভারি হবে, এটুকু সহ্য
না করলেই নয়। কিন্তু ‘নে’ বিভক্তির জায়গাটা মুখস্ত করে সামলাবার ব্যাপার নয়, বুঝে
নেবার ব্যাপার। বাক্যের বিভিন্ন কুশীলব নিয়ে ক্রিয়াপদের যে সংসার সেটার বন্দোবস্ত
খানিকটা ধরতে পারলে হিন্দির এই জায়গাটা আর বাধার মতো দেখায় না। ঢিবিকে পর্বত ভাবার
ভুলটা না করাই তো ভাল। দেখি একটু চেষ্টা করে, এই এলাকায় আমাদের যে অস্বস্তি সেটা
কাটাতে পারি কিনা।
উপন্যাস পড়তে গিয়ে যেরকম জানতে ইচ্ছে করে ‘নায়ক বা নায়িকা কে?’, তেমনি একটা
বাক্যেও আমরা সারথি বা নায়ক বা মালিকের দেখা পাব বলে আশা করতে থাকি, যার পরিচয়
পেলে বাক্যটার আদল ধরতে পারব, যাকে ইংরিজিতে বলি সেনটেন্সটার সাবজেক্ট। বাক্যের ওই
মালিককে চিনে নেবার পরিচিত উপায়গুলো যখন এদিক ওদিক ছড়িয়ে যায় – যেটা হিন্দি ‘নে’
বিভক্তি চিহ্নিত বাক্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য – তখন বাক্যে ক্রিয়ার সঙ্গে কার কী
সম্পর্ক সেটা একটু গুলিয়ে যায়, তাই আমাদের অসুবিধে হয়।
সাধারণ বাক্যের দৃষ্টান্ত
(১) লড়কা পাঁচ রোটিয়াঁ খা লেগা
‘ছেলেটা পাঁচটা রুটি খেয়ে নেবে’
এখানে মালিকানার সূচকগুলো সমস্বরে একই কথা বলে, চট করে ধরতে পারি ক্রিয়ার
মালিক এখানে ‘লড়কা’, ছেলেটা। এরকম বেদাগ বা আনমার্কড বাক্যের বদলে যদি আমাদের
(২)-য়ের মতো, ‘নে’ বিভক্তি চিহ্নিত, দাগি অথবা মার্কড বাক্যের সম্মুখীন হতে হয় –
(২) লড়কে নে পাঁচ রোটিয়াঁ খা লীঁ
‘ছেলেটা পাঁচটা রুটি খেয়ে নিল’
তখন ঠিক কীরকম ফাঁপরে পড়ি, মন দিয়ে দেখুন। ধাপে ধাপে না এগোলে পথ হারিয়ে
ফেলতেই পারেন।
প্রথম বাক্যের সমাপিকা ক্রিয়া ‘লেগা’-য় দেখতে পাচ্ছি তার মালিক ‘লড়কা’-র
পুংলিঙ্গ আর একবচন এই দুই লক্ষণের প্রতিফলন। অথচ (২)-এর সমাপিকা ক্রিয়া ‘লীঁ’-তে
পরিষ্কার দেখছি ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’-র স্ত্রীলিঙ্গ আর বহুবচন প্রতিফলিত। বেদাগ বাক্য
(১)-এর ক্রিয়াপদ তার মালিক বা সাবজেক্টের লিঙ্গ আর বচন প্রতিফলন করে। কিন্তু
‘নে’-ওয়ালা বাক্যে ক্রিয়াপদ তার বদলে অবজেক্টের দিকে ঝুঁকে পড়ে (আমরা অবজেক্টকে
বলব ‘সম্বল’)। এই নাটক দেখে আমাদের মনের একটা দিক বলে ওঠে, তাহলে কি (২)-এর বেলায়
লড়কাটা মালিকানা থেকে ইস্তফা দিল? পাঁচ রোটিয়াঁই কি বাক্যের মালিক হয়ে দাঁড়াল
তাহলে?
এই সংশয়ের নিরসন করতে গিয়ে নাহয় হিন্দির কোনো শিক্ষার্থী ভেবে নিলেন যে (২)-এর
মালিকের আসনে পাঁচ রোটিয়াঁকেই বসানো হল। এতে কি গল্পটা শেষ করে দেওয়া যায়? তাহলে
একটু অদ্ভুত কসরত করে নাচতে হলেও বিদ্যালাভের খাতিরে আমরা নাহয় পাকাপাকি (২)-এর
মতো দৃষ্টান্তে ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’-কে মালিক বলে মেনে নিতাম, ল্যাঠা যেত চুকে। কিন্তু
ওটা কোনো সমাধান নয়, পাল্লা ওই দিকে ঝুঁকে গেলে তখন আবার অন্য জায়গায় মুশকিল বাধে।
হিন্দিতে তো সম্বলের নির্দিষ্টতা বোঝাতে ‘কো’-বিভক্তির প্রয়োগ আছে – (৩)-এর
সঙ্গে (৪) মিলিয়ে দেখলেই বুঝবেন কথাটা –
(৩) রাকেশ আজ বিল্লী খরীদেগা
‘রাকেশ আজ বেড়াল কিনবে’, বনাম:
(৪) রাকেশ আজ বিল্লী কো ওয়াপস ভেজেগা
‘রাকেশ আজ বেড়ালটাকে ফেরত পাঠিয়ে দেবে’
এই নির্দিষ্টতাবাচক ‘কো’ এসে পড়লেই ‘নে’-ওয়ালা বাক্যে সম্বলের সঙ্গে ক্রিয়ার
প্রতিফলনের সম্পর্ক রদ হয়ে যায় –
(৫) রাকেশ নে আজ বিল্লী খরীদী
‘রাকেশ আজ বেড়াল কিনল’, বনাম:
(৬) রাকেশ নে আজ বিল্লী কো ওয়াপস ভেজা
‘রাকেশ আজ বেড়ালটাকে ফেরত পাঠিয়ে দিল’
অর্থাৎ যদি বা কারুর সংশয়ী মন ঠিক করে ফেলে যে (৫)-এর মালিক রাকেশ নয়, বিল্লী, তবু
সে ধারণাটাও টিকতে চায় না (৬)-এ পৌঁছে, যেখানে ক্রিয়া ‘ভেজা’ রূপটাতে অবিচল থাকে,
যতই আপনি ‘বিল্লী কো’ পালটে ‘বিল্লিয়োঁ কো’ আর ‘রাকেশ নে’ পালটে ‘ইন বচ্চোঁ নে’
করুন না কেন। বলতে ইচ্ছে করে (৬) সংখ্যক বাক্যটার কোনো মালিকই নেই।
যদি (৬)-এ পৌঁছে এরকম অমীমাংসায় আটকে যেতেই হয় তাহলে তো (২)-এর ‘পাঁচ
রোটিয়াঁ’-কে সম্বলের বদলে মালিক ভেবে কোনো লাভ নেই, বরঞ্চ সুস্পষ্ট লোকসান।
সেক্ষেত্রে বরং সম্বলই ভাবি ওকে? – কিন্তু তাহলে তো গোঁত্তা খেয়ে মুশকিলটা আবার
(২)-এর ঘাড়েই চেপে বসে। (২) জাতীয় বাক্যে মালিক তাহলে কে? ওরা কি বেওয়ারিশ মাল?
দুই
এভাবে মাঝখান থেকে প্রশ্ন করে অধীর
আগ্রহে জবাব দাও জবাব দাও বলতে থাকলে জিজ্ঞাসা ঘুরপাক খেতে থাকবে। কোনো জবাবই
মাথায় আসবে না। মালিক আর সম্বলের মুশকিলের জায়গাটা ভাষার আর-সব জিনিসের এমন
মাঝ-মধ্যিখানে রয়েছে যে তাকে চিনতে চাইলে নিকটবর্তী অন্য এলাকার সঙ্গেও পরিচয় হওয়া
দরকার। নইলে গল্পটা জট পাকিয়ে যায়।
ভাষাবিজ্ঞানী যখন একটা বাক্য ধরে
বোঝার চেষ্টা করেন বাক্যটা কীভাবে তৈরি হয়েছে, তার অংশগুলো কী, সেগুলোকে একসঙ্গে
ধরে রাখে কী কী শক্তি, তখন সেই জিজ্ঞাসাকে বলে বাক্যতত্ত্ব (সিনট্যাক্স)।
বাক্যতত্ত্বের বিচারে বাক্যের কোনো অংশ যে কাজ করে, যে বৃত্তি (ফাংশন) নির্বাহ
করে, সেটাকে বলব তার বাক্যতাত্ত্বিক বৃত্তি। ‘মালিক’ একটা বাক্যতাত্ত্বিক বৃত্তির
নাম। ‘মুখ্য সম্বল’ বা সংক্ষেপে ‘সম্বল’-এর কাজও তাই। (৭)-এর মতো বাক্যে আছে ‘বহিন
কো’-র মতো গৌণ সম্বল, সেটাও এইরকম বৃত্তি –
(৭) লড়কা বহিন কো তীন রোটিয়াঁ দে দেগা
‘ছেলেটা বোনকে তিনটে রুটি দিয়ে দেবে’
বাক্যের গতিপ্রকৃতি বুঝবার পক্ষে
সম্বল আর মালিকের মতো এই বাক্যতাত্ত্বিক বৃত্তিগুলো যথেষ্ট নয়। এইটুকু সরঞ্জাম
নিয়ে অন্বয়ের আলোচনা করতে চাইলে বিশ্লেষণ পদে পদে আটকে যাবে। তার কারণ বাক্যের
বাইরের চেহারা থেকে তার হাঁড়ির খবরকে আলাদা করার দরকার হয়। বাক্যতত্ত্ব দুদিকে মুখ
করে থাকে, তাই বাক্যতাত্ত্বিক বৃত্তিরও দুমুখো চেহারা। একটা মুখ বাক্যের মানে বা
আধেয়র দিকে ফেরানো; আরেকটা মুখ বাক্যের চেহারা বা আকৃতির দিকে। তাই বাক্যতত্ত্বের
সূত্রে বাক্যের আধেয় আর আকৃতি নিয়েও গুছিয়ে কথা বলার দরকার এসে পড়ে। সেজন্যে আরও
কিছু ধারণার পরিচয় দিলে ভাল হয়। আধেয়র কথাই প্রথমে তোলা যাক। আকৃতির দিকে পরে
তাকাব।
এভাবে বললে মনে হতে পারে বৈয়াকরণ
বুঝি নিজের খেয়ালখুশি মতো এইসব সরঞ্জাম বানিয়ে আনন্দ পান। কেনই বা বাক্যের মানে আর
বাক্যের চেহারাকে আলাদা করার দরকার হয়? একটা হিন্দি বাক্যের যে দিকটা বাংলায়
অনুবাদ করলে বদলায় না, সেইটাকে বলব তার মানে; যে সমবায়রীতি হিন্দি বাক্যটারই
নিজস্ব তাকে বলব বাক্যের আকৃতি। এই কষ্টিপাথরে বিচার করলে আশা করি ভাববেন না নিজের
মনের খুশিতে যা ইচ্ছে তাই করছি?
তাহলে কথাটা দাঁড়াল,
(৮) লড়কে কো পাঁচ রোটিয়াঁ মিলেঙ্গী
আর তার বঙ্গানুবাদ
(৯) ছেলেটা পাঁচটা রুটি পাবে
এ দুই বাক্যের ভিন্ন আকৃতি সত্ত্বেও একই মানে। বাংলায় আমরা সচরাচর ‘ছেলেটার
পাঁচটা রুটি মিলবে’ বলি না, তেমনি উলটো দিকে হিন্দিতেও ‘লড়কা পাঁচ রোটিয়াঁ পায়েগা’
বাক্যটা একেবারে অচল না হলেও মোটের উপর অনেক কম সচল। বক্তব্যটার স্বাভাবিক বা
বেদাগ প্রকাশ বাংলায় (৯) আর হিন্দিতে (৮)। অতএব ধরে নিতে পারি (৮) আর (৯)-এর একই
মানে, একই আধেয়। অথচ আকৃতির তো গুরুতর তফাত আছে। (৮)-এ ক্রিয়া ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’-র
বচন-টচন প্রতিফলন করছে, আর ‘লড়কে’-র গায়ে পাচ্ছি ‘কো’ বিভক্তি। (৯)-এ ‘ছেলেটা’-ই
ক্রিয়ার মালিক এবং তারই বচনাদি ক্রিয়ায় প্রতিফলিত (মালিক যদি ‘ভদ্রলোক’ হত তাহলে
ক্রিয়ার চেহারা ‘পাবে’ না হয়ে ‘পাবেন’ হত)। (৮)-এর মালিক কে? চট করে বলা যাবে না।
এইরকম দৃষ্টান্ত নিয়ে গুছিয়ে কথা
বলতে চাই বলেই বাক্যের আকৃতি আর মানে আলাদা ধরে নিয়ে আলোচনা করার দরকার পড়ে। (৮)
আর (৯) যে সমার্থক বাক্য এ কথা গুছিয়ে বলবার জন্যে অন্য কলকব্জা লাগে। আধেয়
বিশ্লেষণ করাই সেই সরঞ্জামের কাজ। যেমন আমরা বলব, সম্বল বা মালিকের মতো
বাক্যতাত্ত্বিক বৃত্তির সংস্থান যাই হোক না কেন, (৮) আর (৯)-এর আধেয়গত বৃত্তিগুলো
একই। (৮)-এর লড়কার সঙ্গে তার ‘মিলেঙ্গী’ ক্রিয়ার যে সম্পর্ক, (৯)-এর ‘ছেলেটা’র
সঙ্গে ‘পাবে’ ক্রিয়াপদের সেই একই সম্পর্ক। তাই বলব, ছেলেটার আর লড়কার এখানে ভূমিকা
‘প্রাপক’-এর – প্রাপক কথাটা ওর আধেয়তাত্ত্বিক বৃত্তি বোঝানোর তকমা। প্রাপক যা
পাচ্ছে তা হল ওই পাঁচখানা রুটি; আধেয়গত বিচারে সেই রুটি উভয় বাক্যেই একই ভূমিকায়
অবতীর্ণ। সেই ভূমিকার তকমা ‘আশয়’। প্রাপক বা আশয় বললে বাক্যের আধেয়গত মানচিত্র
স্পষ্ট হয়। এই মানচিত্র থেকে আমরা সাবধানে আর-সব প্রশ্নকে আলাদা রাখছি।
বাক্যতাত্ত্বিক বিচারে কি (৮)-এর
সঙ্গে (৯)-এর মস্ত তফাত? (৯)-এর বাক্যতত্ত্বে স্পষ্টতই ‘ছেলেটা’ বসেছে মালিকের
আসনে, আর ‘রুটি’ সেখানে সম্বল। (৮)-এ কি এই গল্পটাই বলব, নাকি উলটে দিয়ে সেখানে
‘রোটিয়াঁ’-কেই বলতে হবে মালিক? ‘লড়কে কো’ কি (৯)-এ গৌণ সম্বল? ও প্রশ্নটা বেশ শক্ত
– ওর বিচারের সরঞ্জাম হাতে নিয়ে বসি নি এই প্রবন্ধে। ধাপে ধাপে এগোই, কেমন? আপাতত
(৮)-এর বাক্যতত্ত্ব মুলতুবি রেখে এটুকুই বলি যে (৯) আর (৮) চেহারার বা আকৃতির
বিচারে খুবই আলাদা। সেই কথাটুকু ঠিকমতো বলবার জন্যেও একটু জমকালো যন্ত্রপাতি লাগবে
যে।
(৮)-এর ক্রিয়া ‘মিলেঙ্গী’-তে পাচ্ছি
‘পাঁচ রোটিয়াঁ’-র বচনাদি লক্ষণের প্রতিফলন। আর ‘ছেলেটা’-র লক্ষণগুলো (৯)-এর ক্রিয়া
‘পাবে’-তে প্রতিফলিত। (৮) আর (৯)-এর এই তফাতটা স্পষ্ট ফুটে ওঠে যদি বলতে পারি, এ
দুই বাক্যে ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’-র আকৃতিক বৃত্তি ‘ছেলেটা’-র সমান। বিশেষ্যের বেলায়
আকৃতিক বৃত্তিকে ইংরিজিতে বলে ‘কেস’। বর্তমান ক্ষেত্রে বলা হবে, (৮)-এ আর (৯)-এ
যথাক্রমে ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’ আর ‘ছেলেটা’-র আকৃতিগত পরিচয় এই যে এদের কেসটা নমিনেটিভ।
চট করে ভারতীয় ভাষায় আমরা প্রায়ই বলে
দিই, কেসের তুল্যমূ্ল্য ‘বিভক্তি’; আর নমিনেটিভকে বলি ‘প্রথমা’। কিছু কাজ এতেই চলে
যায়। কিন্তু দ্ব্যর্থহীন কথা বলতে চাইলে আরেকটু ভেঙে বলতে হবে। যে ভাষার পণ্ডিতদের
হাতে ‘বিভক্তি’ ধারণাটা তৈরি হয়েছিল, সেই সংস্কৃতের শব্দরূপের সুপরিচিত নরঃ নরৌ
নরাঃ ছত্রটার কথা ভাবুন। নিছক আকারের মূর্ততম বিচারে সেই তিনটে পদের পৃথক তিনখানা
দৃষ্টিগোচর ‘আকার-বিভক্তি’ (সুপ্ ঔট্ জস্)। কিন্তু প্রকারের বিমূর্ততর বিবেচনায়
এদের আবার একটাই ‘প্রকার-বিভক্তি’, যাকে বলে প্রথমা। এভাবে কথা বলা একটু শক্ত।
‘আকার-বিভক্তি’-কে বিভক্তি না বললেই নয়। তাই ‘কেস’ ওরফে ‘প্রকার-বিভক্তি’-র বাংলা
প্রতিশব্দ হিসেবে ‘প্রপাত’ চালু করেছিলাম আমার “কথার ক্রিয়াকর্ম” বইয়ে। নমিনেটিভ
কেসকে ‘অভিধেয় প্রপাত’ বলার প্রস্তাবটাও সেখানেই পাবেন।
ক্রিয়ার প্রতিফলনের সঙ্গে সম্পর্কহীন
‘পাঁচটা রুটি’-র বেলায় অবধেয় প্রপাত, অবজেকটিভ কেস; আর ‘লড়কে কো’-র ওই ‘কো’ আরেকটা
প্রপাতের সূচক যার নাম ডেটিভ কেস, প্রতিধেয় প্রপাত।
এই সরঞ্জামের আলো এবার ফেলতে চাইব
(১) আর (২)-এর উপর, ভুলে গেছেন নিশ্চয়ই কী ছিল ওই-দুটো দৃষ্টান্ত – (১) লড়কা পাঁচ
রোটিয়াঁ খা লেগা, (২) লড়কে নে পাঁচ রোটিয়াঁ খা লীঁ। ভবিষ্যতের সঙ্গে অতীতের
কালপার্থক্যের কথা বাদ দিলে বাক্য দুটোর মানে তো একই। আধেয়গত বিচারে দু জায়গাতেই
আশয়ের ভূমিকায় ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’ অবতীর্ণ। আর ‘লড়কা’র ভূমিকাটাকে ইংরিজিতে এজেন্ট
বলে, আমরা নাহয় ‘নায়ক’ বললাম?
এইবার খুঁটিয়ে দেখুন ‘নে’-ওয়ালা (২)-এর সঙ্গে বেদাগ বাক্য (১)-এর তফাতটা
কোথায়। প্রথম বাক্যে যে ‘লড়কা’ আধেয়র দিক থেকে ক্রিয়ার নায়ক সে-ই যে আকৃতির
বিচারেও অভিধেয় প্রপাতটাই পেল – ক্রিয়া যে তারই বচনাদির প্রতিফলন করছে, তার গায়ে
যে দৃষ্টিগোচর কোনো বিভক্তি নেই – আধেয় আর চেহারার এই মণিকাঞ্চনযোগ দেখেই বৈয়াকরণ
বলে ওঠেন, এই দেখো বাক্যের মালিক। একইভাবে (১)-এর আশয় ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’-র অবধেয়
প্রপাত দেখে বলেন, এটাই সম্বল (দৃষ্টিগোচর কোনো বিভক্তি নেই অথচ ক্রিয়ার সঙ্গে
প্রতিফলনের সম্পর্ক নেই, হিন্দিতে আর বাংলায় এটাই অবধেয় প্রপাতের লক্ষণ)। এই
পরিষ্কার ছবিটা ‘নে’-ওয়ালা (২)-এ এসে গুলিয়ে যায় বলেই লোকে ‘নে’ বিভক্তিটাকে
গোলমেলে ভাবে।
(২)-এর মানেটা (১)-এরই মতো; নায়ক লড়কা, আশয় পাঁচ রোটিয়াঁ। কিন্তু প্রতিফলনের
রকম সকম দেখে মালুম হয়, অভিধেয় প্রপাত এবার নায়ক থেকে সরে আশয়ে এসে ভর করেছে। তার
বদলে নায়কের কপালে জুটেছে এক ব্যতিক্রমী প্রপাত যাকে বলব ব্যতিধেয়, যার বিখ্যাত
বিভক্তি ‘নে’। নায়ক আর অভিধেয় এক জায়গায় না দেখলেই ভাষার শিক্ষার্থীর অসুবিধে হয়।
ব্যতিধেয় প্রপাত সেইজন্যে বিশেষ চেষ্টা করে শিখে নেওয়ার জিনিস।
এ ধরনের বিষয় আনুপূর্বিকভাবে ধাপে ধাপে শিখতে বসে কোনো কোনো পাঠকের সারণি না
হলে চলে না। তাঁদের পছন্দের কথা ভেবে আধেয়গত বৃত্তির তালিকা ছকেছি (১০)-এ; আকৃতিগত
বৃত্তি ওরফে প্রপাতের ফর্দ পেশ করেছি (১১)-য়; ইংরিজি পরিভাষাও দেওয়া রইল; তাছাড়া
(১১)-তে দেখতে পাবেন হিন্দিতে একেকটা প্রপাতের সূচকের চেহারা।
(১০) আধেয়গত বৃত্তি থীটা-রোল
আশয় থীম
নায়ক এজেন্ট
নীত পেশেন্ট
প্রাপক রেসিপিয়েন্ট
উপপ্রাপক বেনিফিশিয়ারি
ভোক্তা এক্সপিরিয়েন্সার
উপায় ইনস্ট্রুমেন্ট
লক্ষ্য গোল
উৎস সোর্স
স্থল লোকেশন
(১১) প্রপাত কেস হিন্দি
বিভক্তি
অভিধেয় নমিনেটিভ ০ + প্রতিফলন
অবধেয় অ্যাকিউজেটিভ নিছক শূন্য
প্রতিধেয় ডেটিভ কো
বিনিধেয় ইনস্ট্রুমেন্টাল সে
উদ্ধেয় জেনিটিভ কা
অনুধেয় লোকেটিভ মেঁ
ব্যতিধেয় আর্গেটিভ নে
এই সরঞ্জাম হাতে নিয়ে অন্যান্য
বাক্যের দিকে তাকানো যাক। (৫)-এ দেখছি আশয় অভিধেয়র পাশে নায়ক ব্যতিধেয়। কিন্তু
(৬)-এর ছবিটা আরেক কাঠি সরেস। সেখানে ‘রাকেশ’ আধেয়গত বৃত্তিতে নায়ক, প্রপাতের
গণনায় ব্যতিধেয়; আর ‘বিল্লী’ প্রকারে আশয় হলেও আকারে সে প্রতিধেয়, কারণ তার
বিভক্তি তো দেখতেই পাচ্ছি ‘কো’। মানে, ওই বাক্য আদৌ কোনো অভিধেয় নেই। প্রতিফলন
করার কিছুই না পেয়ে ক্রিয়া তাই ‘রিক্ত’ বচনাদি ধারণ করে – তৃতীয় তরফ পুংলিঙ্গ
একবচন। (‘তরফ’ কথাটার মানেটুকু আন্দাজ করতে পারছেন না? এরকম অদ্ভুত কথা বলে লজ্জা
দেবেন না। আলবত পারছেন। সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ার পর যে পাঠক অজ্ঞতার ভান করতে চান
তিনি নাহয় একটু পুস্তক পর্যালোচনাগুলো পড়ে নেবেন!) আমরা বলব, এই বাক্যে রয়েছে
রিক্ত অভিধেয়।
জানতে চাইছেন এই বিশ্লেষণের কোনো
বিকল্প আছে কিনা? কেউ কেউ (৬)-এর ওই ‘কো’-টাকে আসলে অবধেয় প্রপাতেরই আরেক চেহারা
বলে মানেন কিনা? বৈয়াকরণদের পাড়ার ওরকম অলি গলি আছে বইকি। কিন্তু আমি বলি কী, আগে
বড় রাস্তাগুলো চিনে ফেলুন, পরে এদিক ওদিক বেড়িয়ে নিজেই নাহয় দেখে নেবেন কোথায়
আপনার বিশেষ বিশেষ পছন্দের ঠিকানা।
বড় রাস্তা ধরে ফিরে যাই (৩) সংখ্যক
দৃষ্টান্তে, রাকেশ আজ বিল্লী খরীদেগা। সেখানে ‘রাকেশ’ অভিধেয় নায়ক, ‘বিল্লী’ অবধেয়
আশয়। কোনো মন্তব্য করার দরকার নেই। (৪)-এর বাক্যটা ছিল রাকেশ আজ বিল্লী কো ওয়াপস
ভেজেগা। সেখানে ‘রাকেশ’ ফের অভিধেয় নায়ক। কিন্তু আশয় ‘বিল্লী’ এবার ‘কো’ বিভক্তি
পেয়ে প্রপাত পালটে প্রতিধেয় হয়ে দাঁড়ায়; এইটুকু বিশেষ ঘটনা। ‘কো’-ওয়ালা প্রতিধেয়রা
(৭) আর (৮)-এ আধেয়র বিচারে আশয় নয়, প্রাপক। (৭)-এ এই প্রাপকের দুই প্রতিবেশী –
অভিধেয় নায়ক ‘লড়কা’ আর অবধেয় আশয় ‘তীন রোটিয়াঁ’। আর (৮)-এ প্রাপকের একটাই সঙ্গী,
অভিধেয় আশয় ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’; কোনো নায়ক নেই এই বাক্যে।
মানে আর চেহারা কত রকম সম্পর্কে
অন্বিত হতে পারে তার বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া গেল – সারণি ছকে দিলে কিছু কথা হয়তো
পরিষ্কার হবে।
(১২) আধেয় আর আকৃতির সংস্থানের ছক
প্রপাত আধেয়গত
বৃত্তি নমুনা
ক। অভিধেয় আশয় রোটিয়াঁ ২,৮;
বিল্লী ৫
খ। অভিধেয় নায়ক লড়কা ১, ৭; রাকেশ
৩, ৪
গ। অবধেয় আশয় রোটিয়াঁ ১, ৭;
বিল্লী ৩
ঘ। প্রতিধেয় প্রাপক বহিন ৭; লড়কা ৮
ঙ। প্রতিধেয় আশয় বিল্লী ৪, ৬
চ। ব্যতিধেয় নায়ক লড়কা ২, রাকেশ ৫,
৬
লোকে চট করে (১২)-র খ-কে মালিক বলতে,
এবং গ আর ঙ-কে সম্বল বলতে, রাজি হয়। মালিক বা সম্বলের মতো বাক্যতাত্ত্বিক বৃত্তি
শনাক্ত করার পিছনে এই পছন্দটাই কাজ করে। কিন্তু (১২)-র ক-সংস্থানটাকে (২) আর
(৫)-এর মতো বাক্যের বেলায় অনেকেরই সম্বলের মতো লাগে, অথচ (৮)-এর বেলায় সেই একই
ক-য়ের গা থেকে কেমন যেন মালিক-মালিক গন্ধ বেরোয়। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যেসব রুচি,
যেসব অনুভূতিকে পোশাকি স্বীকৃতি দেবার জন্যে বাক্যতাত্ত্বিক সরঞ্জামের অবতারণা,
সেগুলোর স্পষ্ট কোনো ছবি চটজলদি ছক থেকে ছেঁকে তোলা কঠিন।
সেক্ষেত্রে হিন্দি যিনি মন দিয়ে বুঝে
শুনে শিখতে চাইছেন তাঁকে কী পরামর্শ দেওয়া যায়? আমরা বলব, মন থেকে মালিক আর
সম্বলের কথা সচেতনভাবে সরিয়ে রেখে ‘নে’ সমস্যাটার জট ছাড়িয়ে নিন। ওই বাক্যগুলোর
বেলায় খালি আধেয়গত বৃত্তির দিকে আর প্রপাতের দিকে মন দেবেন, ব্যস।
বাক্যে যদি নায়ক থাকে – মনে রাখবেন,
‘নায়ক’ একটা আধেয়গত বৃত্তি – তাহলে এমনিতে তার গায়ে তো অভিধেয় প্রপাতের শূন্য (এবং
ক্রিয়ায় প্রতিফলিত) বিভক্তি বসে, এটাই দস্তুর। কিন্তু হিন্দিতে অতীত আর পুরাঘটিত
কালগুলোতে নায়ক চলে যায় ব্যতিধেয় প্রপাতে – অঙ্গে ‘নে’ বিভক্তি ধারণ করে – বলে
যায়, আশয় কে আছিস, তুই তো এমনিতে অবধেয় হবি ভাবছিলি, আমি বলছি তুই অভিধেয়ত্ব নিয়ে
নিবি। বাক্যে যদি এমন আশয় থাকে যার এমনিতে অবধেয় হবার কথা ছিল, সে তাহলে নায়কের
বিশেষ ডাকে সাড়া দিয়ে অভিধেয় হয়ে বসে। (১) থেকে এইভাবে আমরা (২) পাই, আর (৩) থেকে পাই
(৫)। কারণ (১)-এ আর (৩)-এ এই ধরনের আশয় সত্যিই হাজির রয়েছে।
কিন্তু বাক্যে তো ওই ধরনের আশয় না
থাকতে পারে। যেমন (৪)-এ দেখছি আশয় ঠিক করেছে প্রতিধেয় হবে। ওই ধরনের বাক্যের বেলায়
অতীতাদি কালে নায়কটাই শুধু ব্যতিধেয় হয়ে ‘নে’ ধারণ করে। অবধেয়-ফসকানো অভিধেয়র
জায়গাটা ফাঁকা থাকে। ফলে ক্রিয়ায় কোনো কিছুর তরফাদি প্রতিফলিত না হয়ে ‘রিক্ত’
তৃতীয় তরফ পুংলিঙ্গ একবচন দেখা দেয়; (৪)-এর অতীত সংস্করণ (৬) দেখুন। ইচ্ছে করলে
বলতে পারি (৪)-এ রয়েছে রিক্ত অবধেয়, (৬)-এ সে হয়ে ওঠে একাধারে রিক্ত অভিধেয় তথা
অবধেয়; তবে রিক্ত অবধেয় ব্যাপারটা বৈয়াকরণ মহলে একেবারে সবাই মানেন বললে অত্যুক্তি
হবে; ওদিকে বরং না গেলাম এ যাত্রা।
অতীতাদি কালে বাক্য রচনা করতে চাইলেই
কি এইসব প্যাঁচ কষতে হয়? না, বাক্যে নায়ক আর অবধেয়-ধর্মী আশয় থাকলে তবে অতীতাদি
কালে এই ধরনের মুশকিল সামলানোর দরকার পড়ে। (৮)-এ নায়কও নেই, আর ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’ও
অবধেয়তায় অঙ্গীকারবদ্ধ আশয় নয়, ফলে (৮)-এর অতীত কালের রূপের কোনো ঝুট ঝামেলা নেই –
(১৩) লড়কে কো পাঁচ রোটিয়াঁ মিলীঁ
কোনো ব্যতিধেয় নেই, (৮) থেকে (১৩)-য়
যেতে মানে আর চেহারার সম্পর্কগুলোও পালটে গেল না কোথাও। আর (১৪)-য় নায়ক আছে,
মুকেশ/ রীতা, কিন্তু আশয় নেই, তাই নায়কের পক্ষে তার স্বাভাবিক অভিধেয়ত্বটা কোনোরকম
আশয়কেই দিয়ে যাবার সুযোগ নেই। ফলে (১৪)-র অতীত রূপ (১৫)-তেও নায়কই অভিধেয়ত্ব রেখে
দেয় –
(১৪) মুকেশ দৌড়েগা, রীতা দৌড়েগী
(১৫) মুকেশ দৌড়া, রীতা দৌড়ী
তার মানে দাঁড়াচ্ছে, হিন্দি শিক্ষার্থীর
বিশেষ কাজে লাগবে না বাক্যতত্ত্বের নিজস্ব কেন্দ্রীয় ধারণা মালিক বা সম্বল।
চেহারার দিকে প্রপাত আর মানে-র দিকে নায়ক ইত্যাদি আধেয়গত বৃত্তি, এই দু কূল রাখার
ব্যবস্থা যে শিক্ষার্থী করতে পারবেন – সে কাজে হয়ত তাঁকে (১) থেকে (১৫) অবদি আমাদের
যে আলোচনা সেটা কিছু দূর সাহায্য করবে – তিনি বাক্যতত্ত্বের প্রিয় মালিক আর
সম্বলের প্রসঙ্গকে উপেক্ষা করলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। বাইরের জিনিস নানা পাশ থেকে
দেখতে দেখতেই আমরা বিষয়ের ভিতরের দিকে ক্রমশ এগোই, এবং অল্প কিছু দূর এগোতে পারলে
ভালোই কাজ চলে। ভাষার সঙ্গে শিক্ষার্থীর
সম্পর্ক তৈরির ব্যবহারিক কাজের বোধহয় কোনো লাভ হবে না যদি শুধু শুধু
বাক্যতাত্ত্বিক বৃত্তির প্রসঙ্গ এনে ফেলি। তবে ভাষা নিয়ে যে পাঠক আরো বেশি খুঁটিয়ে
সওয়াল জবাব করতে চান তাঁর বিশ্লেষণের বা জিজ্ঞাসার লাভ হতেও পারে; এই ভেবে আলোচনার
জের আরো খানিক দূর টানছি। বলা বাহুল্য, এ আলোচনার কোনো সত্যিকারের শেষ নেই। কার
কতটা দরকার সেই হিসেব মাথায় রেখে কোনো এক জায়গায় লেখায় অথবা পড়ায় ছেদ টানতে হয়।
তিন
কেবল হিন্দি ভাষার বাঙালি
শিক্ষার্থীর প্রয়োজনের পক্ষেই যে আধেয়গত বৃত্তি আর প্রপাত যথেষ্ট তাই নয়। যাঁরা হিন্দির
সযত্ন বিবরণ লিখবেন – ওই যে ভারত সরকারের হয়ে লোকে সরকারি ব্যাকরণ ট্যাকরণ লেখে আর
কী, যাকে বলে ভাষার সন্নয়ন, স্ট্যাণ্ডার্ডাইজেশন – তাঁদের কাজটাতেও আধেয়র আর
আকৃতির দু কূল রাখাই যথেষ্ট। কী আছে তার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ আমরা দিতেই পারি, মালিক
সম্বলকে হিসেবের বাইরে রেখে। কিন্তু এতে মনে হয় কী যেন একটা বোঝা বাকি রয়ে গেল। যদি ভাষার মূলসূত্র
বুঝতে চাই, যদি জানতে চাই মানে আর চেহারা কী সূত্রে গাঁথা থাকে, তাহলে সম্বল
মালিকের প্রশ্ন ভাষাজিজ্ঞাসায় এসে পড়বেই।
এই কথাটাই আরেকভাবেও বলা চলে। আজকের
যুগ আন্তর্বৈষয়িক আলোচনার যুগ। একটা বিষয়েরই নিজস্ব টুলো পণ্ডিতি গবেষণায় যে লোক
আটকে যায় তাকে কূপমণ্ডূক ভাবা হয়। ভাষার আকৃতিবর্ণনার প্রপাত আর আধেয়বর্ণনার
বৃত্তির মতো বৈশেষিক গণনায় মেতে যাবার ঝোঁক ভাষাবিজ্ঞানীর হতেই পারে। ফলিত
ভাষাবিজ্ঞান হয়তো এসব সরঞ্জাম লোকের কাজে লাগিয়ে এর কিছু উপযোগিতাও দেখিয়ে দেবে।
কিন্তু এতে অনেকের মন ভরে না। ভাষাবিজ্ঞানের সেইসব কথাই অনেকে জানতে চান যার
ব্যাপকতর গুরুত্ব এবং প্রযোজ্যতা রয়েছে। আরো নানা বিদ্যায় যা ভাবা হচ্ছে তার সঙ্গে
এ ধরনের কথা সেতুবন্ধনের কাজ করবে। আশয় বৃত্তি কিংবা অভিধেয় প্রপাত যে এরকম কোনো
ব্যাপক আগ্রহ জাগিয়ে তোলার মতো তৎক্ষণাৎ আকর্ষণ করা বিষয় নয় সেটা বোধহয় স্পষ্ট। কিন্তু মালিক আর
সম্বলের, সাবজেক্ট আর অবজেক্টের, রয়েছে সেই ব্যাপ্তির জোর।
সম্বলের সঙ্গে মালিকের মোলাকাতের
বিষয়টা আধুনিক ভাবনায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে। মানবিক বিদ্যাক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি
কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতেও সাক্ষী চৈতন্য হিসেবে মালিকের ভূমিকা এসে পড়ে। স্থূলভাবে
বলতে পারি, মালিক আর সম্বল শব্দের এই বিশেষ অর্থে মালিকের দিকটা মোটের উপর মানুষের
বা মনের; আর মানুষ যার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই জগতের বা পদার্থের দিকটা সম্বলের
দিক। এ দুটো দিকের ভেদাভেদ নিয়ে বা পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে অনেকেই ভেবেছেন, প্রচুর
ভেবেছেন, লক্ষ করুন যে এই বাক্যে ‘অনেকেই’ কথাটা মালিক আর ‘প্রচুর’ শব্দটা বাক্যের
সম্বল! পাঠকরা নিজের নিজের আগ্রহের নানা ক্ষেত্রে এই বিষয়টার গুরুত্বের কথা মনে
করতে পারবেন নিশ্চয়ই, তাই পাঁচরকম দৃষ্টান্ত দাখিল করে এখানে কথা বাড়াব না।
ভাষাবিজ্ঞানের প্রসঙ্গে মালিক আর সম্বল নিয়ে যা বলবার সেটুকুই বরং বলে নিই।
বাক্যের চেহারা থেকে যে মানে আলাদা,
চেহারার প্রপাতবিশ্লেষণ আর মানের বৃত্তিবিশ্লেষণ যে বাক্যতত্ত্বকে দু দিকে টানে,
এটা বুঝতে পেরেও আমরা বাক্যের বাক্যতা বলে একটা কোনো ঐক্যকে ধরতে চাই। সে ঐক্যে
চাই আকৃতি আর আধেয়র যৌথ উপস্থিতি। প্রত্যাশা করি, সেই ঐক্য থেকেই একই রস নানা পথ
বেয়ে আকৃতিতেও সঞ্চারিত হবে, আধেয়তেও প্রবাহিত হবে। বাক্যের বাক্যতা ধরে রাখা যে
ঐক্য আমাদের ইষ্ট, সেই ইষ্ট সম্পর্কজালকেই বলি বাক্যতত্ত্ব। মালিক আর সম্বলের যে
বাক্যতাত্ত্বিক বৃত্তি তার কোনো বাস্তবতা থাকলে এই পর্যায়ে পড়ে।
যে বাক্যে মালিক বলে কিছু আছে সেই
বাক্যে মালিককে দেখে মনে হয় আসল সদস্য। (১)-এর মতো বাক্যকে ‘লড়কা’-ই চালাচ্ছে যেন।
প্রপাতে সে অভিধেয়, অর্থাৎ ক্রিয়া তার বশংবদ। আধেয়গত বৃত্তিতে সে নায়ক, মানে
পাঁচখানা রুটি খাওয়ার কাজটা তারই কীর্তি বলে প্রতীয়মান। যখন বলি ‘লড়কা’ এই বাক্যের
মালিক, তখন আধেয়র স্তরে নায়কের অগ্রগণ্যতা আর প্রপাতের স্তরে অভিধেয়র অগ্রগণ্যতার
যুগপৎ স্বীকৃতি দিই। এই বাক্যের ক্রিয়া দুই অর্থে মালিকের হাতে – আধেয়তেও তার
নিয়ন্ত্রণের অধীন, আকৃতিতেও তার গুণাদি প্রতিফলন করতে বাধ্য।
যার হাতে ক্রিয়া তাকে মালিক বলি। আর
ক্রিয়ার হাতে যে লোক বা যে জিনিস তাকে বলি সম্বল। (১)-এর সম্বল তাই ‘পাঁচ
রোটিয়াঁ’। প্রপাতে এবং আধেয়তে সে যে খাওয়া ক্রিয়ার একান্ত অনুগত প্রজা একথাই বলি
অবধেয় আর আশয়ের মতো শব্দের সাহায্যে। অবধেয় প্রপাত ক্রিয়ারই উপহার। এবং আশয় বলি ক্রিয়ার
সেই অবিচ্ছেদ্য সঙ্গীকেই যা একান্তই ক্রিয়ার চলনে চলে, ক্রিয়ার স্থিতিতে থাকে, যা
নিজেকে জাহির করে না। খাওয়ার আশয় খাদ্য, পোড়ার আশয় দাহ্য পদার্থ, মরার আশয় মৃত
ব্যক্তি বা প্রাণী (থুড়ি, মৃত বা ম্রিয়মাণ! আমার ভুলভাল কথা শুনে মুমূর্ষুরা
চেঁচিয়ে উঠল কিনা, তাই এই সংশোধন), দেওয়ার আশয় দানসামগ্রী। (১৪)-য় দৌড়োনোর কোনো
আশয় নেই, কারণ ধাবমান ব্যক্তিকে আশয় ভাবা যায় না। সে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগে
দৌড়োয় বলে তাকে নায়ক ভাবতে হয়। ধরে নিতে হয় সে নিজেকে জাহির করছে বা করতে পারে।
তাই সে ক্রিয়ার বশংবদ সম্বল নয়। সে মালিক; ক্রিয়াই তার বশংবদ।
এসব দেখে মনে হতে পারে, বাক্যকে
বুঝতে চাইলে সম্বলকে আর বিশেষ করে মালিককে বোঝা দরকার। বাক্যটা মালিকেরই নাটক। তারই
হাতে ক্রিয়া, আর সম্বল থাকলে ক্রিয়ার হাতেই সম্বল। সম্বল আর মালিক তাহলে এমন চাবি
যা বাক্যতত্ত্বের তালা খুলে দেবে। বিশেষত মালিককে চিনে নেওয়া জরুরি।
সুস্পষ্ট উদাহরণের বেলায়, যেমন
(১)-এর মতো বাক্যে, মালিক বা সম্বল চিনে নেওয়া সোজা। সেখানে নাহয় আমরা তাদের চিনে
নিলাম। কিন্তু নায়কের সঙ্গে অভিধেয়তার এবং আশয়ের সঙ্গে অবধেয়তার সহজ ঐক্য ভেঙে
গেলে (২) বা (৮)-এর মতো বাক্য হয়। তখন চট করে ধরতে পারি না ‘কে বা আপন, কে বা অপর,
কোথায় বাহির, কোথায় বা ঘর’। এ ধরনের দৃষ্টান্তে মালিককে খুঁজে বার করতে ইচ্ছে করে।
মালিকের অন্বেষণ, এবং সম্বলের
অন্বেষণও, একটা বড় কাজ হয়ে দাঁড়ায় এইসব কারণে। অনুসন্ধানের পন্থা ভেবে বার করতে
হয়। সোজা জায়গায় মালিক দেখে তার সঙ্গে যেটুকু পরিচয় হয়েছে সেটার ভিত্তিতে (২)-য়ে
বা (৮)-এ মালিক চিনে নিতে পারি না।
ঠিক কী ধরনের অনুসন্ধান করছি সে কথা
বুঝতেও একটু সময় লাগে। মালিকত্ব কোনো গুণ নয়, যে অর্থে নারীত্ব বা পুরুষত্বকে গুণ
বা ধর্ম বলা চলে। মানে, নারী বা পুরুষ যেরকম ‘বর্গ’ বা ক্যাটেগরি, মালিক সেরকম
বর্গ নয়।
ইচ্ছে করে যে ‘মালিকানা’ বলার বদলে ‘মালিকত্ব’ বললাম, ওই উদ্ভট জায়গাটা থেকে
সরে এলেই কি মুশকিল আসান হয়ে যাবে? ‘মালিকানা’ কি একটা গুণ? ধরুন একজন মালিকের
যাবতীয় সম্পত্তি কোনো দুর্বিপাকে চলে গেল; এই বদল কী ধরনের বদল? পুরুষকে নারী অথবা
নারীকে পুরুষ করে দেওয়া অস্ত্রোপচারের সঙ্গে তুলনা করা কি ঠিক হবে?
না, তা বোধহয় হবে না। মালিকের সঙ্গে সম্পত্তির একটা সম্পর্ক আছে, সেইটার জোরেই
তার মালিকানা। ওই একই সম্পর্কের সূত্রে আমরা ওই জিনিসগুলোকে সম্পত্তি বলি –
সম্পত্তিত্ব কোনো গুণ নয়, ওটাও নেহাতই সম্পর্কের রকমফের। পেয়ালা যে পেয়ালা, পিরিচ
যে পিরিচ, সেটা তাদের গুণ। কিন্তু পেয়ালা পিরিচ যে তোমার সম্পত্তি সেটা তাদের
সঙ্গে তোমার সম্পর্কের মামলা। তুমি তোমার পেয়ালা আর কাউকে দিয়ে দিলে সেও পরের
সম্পত্তি হয়ে গেল, তার উপর তোমার মালিকানাও গেল ঘুচে। কিন্তু পেয়ালার যে গুণ ছিল,
পেয়ালাত্ব, সেটার কোনো হেরফের হল না। তুমি একটা দুর্গের প্রহরী ছিলে, কাজ পালটে
পাশের দুর্গের প্রহরী হয়ে গেলে, এতে সম্পর্ক বদলায়, মানুষ বদলায় না।
মালিক খোঁজা কিংবা প্রহরী খোঁজা বলতে তাহলে এইরকম সম্পর্ক খোঁজা বোঝায়। এক
হাতে তালি বাজে না; সম্পর্কেও একাধিক পক্ষ থাকে। ব্যাকরণে মালিক হওয়া মানে বাক্যের
কেউ হওয়া, ক্রিয়ার কেউ হওয়া, সম্বলের সঙ্গেও একরকম আত্মীয়তা পাতানো। মানে, একা
মালিককে খোঁজা বলে কিছু হয় না। আত্মীয়তাগুলোকে বুঝতে পারা দরকার। বাক্য তো আর
তোমায় ডেকে ডেকে বলবে না, এই দেখো, এই যে আমার মালিক, এই আমার সম্বল। যে গ্রাম
কাউকে বলে-কয়ে মোড়লের শিরোপা পরিয়ে দেয় নি তার আসল মোড়ল চিনে নেওয়া মানে
গ্রামটাকেই বুঝতে পারা, সবার সুখ-দুঃখের খতিয়ান নেওয়া, গ্রামের সম্পর্কজালে প্রবেশ
করা।
যে-কোনো একটা ঘটনার দিকে তাকালেই কি বলা যায় ঠিক কার নিয়ন্ত্রণে ঘটছে সেই
ঘটনাটা? বেচা-কেনা তো দু পক্ষের কারবার –
(১৬) দীপেন রূপেনকে আনারস বিক্রি করল
(১৭) রূপেন দীপেনের কাছ থেকে আনারস কিনল
একই ঘটনার দুই প্রতিবেদন বলে (১৬)-র সঙ্গে (১৭)-র সমীকরণ অনেকের কাছেই
গ্রহণযোগ্য মনে হবে। কিন্তু (১৬) বলছে দীপেনই বাক্যের মালিক, (১৭) বলছে মালিক
রূপেন। এই দ্বিত্বটাকে ধরতে পারি যদি বলি একই বহিরঙ্গ প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে দুরকম
নাটক রচনা করছে এ দুই বাক্য। বিক্রয়নাট্যের নায়ক দীপেন। ক্রয়নাট্যে রূপেন নায়ক।
ঘটনা-বিশেষ না পালটেও তার অনুষ্ঠেয় নাটক বদলানো যায় বলেই তো রামায়ণকে উলটে দিয়ে
মাইকেল লিখতে পেরেছিলেন মেঘনাদবধ কাব্য। বাস্তব জগতে ক্রেতা বড় না বিক্রেতা বড় সে
প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে এটুকুই লক্ষ করব যে (১৬)-য় দীপেন অগ্রগণ্য, (১৭)-য় রূপেন।
আধেয়গত বৃত্তিতে দীপেন রূপেনরা নায়ক।
যে বাক্যে এর চেয়ে সক্রিয়তা কম প্রকাশ পায় তার গল্প একটু আলাদা –
(৮) লড়কে কো পাঁচ রোটিয়াঁ মিলেঙ্গী
(৯) ছেলেটা পাঁচটা রুটি পাবে
ছেলে এখানে প্রাপক। নায়ক তো নেই কেউ। তবে কি অভিধেয় দেখে ঠিক করব হিন্দি (৮)-এ
পাঁচ রোটিয়াঁ মালিক আর বাংলা (৯)-এ মালিক ছেলেটাই? একই ভাষার অন্তর্গত (১৬) বনাম
(১৭)-র সঙ্গে কি তাহলে দুই ভাষার সীমান্ত পেরোনো (৮) বনাম (৯)-এর তফাতটা তুলনীয়?
তা কিন্তু নয়। ‘ছেলেটা’ই (৮) আর
(৯)-এর মালিক। এর প্রমাণ আছে –
(১৮) ঘর লৌটকর লড়কে কো পাঁচ রোটিয়াঁ মিলেঙ্গী
(১৯) বাড়ি ফিরে ছেলেটা পাঁচটা রুটি পাবে
লৌটকর বা ফিরে-র মতো পুরাঘটিত
অসমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে যখন বাক্যের মূল কাণ্ডকারখানাকে জুড়তে হয়, তখন কোন্ মালিক
সে কাজ করে দিচ্ছে? স্পষ্টতই ছেলেটা। (১৮)-য় বা (১৯)-এ রুটি বাড়ি ফিরছে না।
ছেলেটারই বাড়ি ফেরার কথা হচ্ছে। এই একই পরীক্ষা করে দেখাতে পারি (১৬)-র সঙ্গে
(১৭)-র তফাত।
(২০) কিছু না বলে দীপেন রূপেনকে আনারস বিক্রি করল
(২১) কিছু না বলে রূপেন দীপেনের কাছ থেকে আনারস কিনল
(১৬)-র আর (১৭)-র মালিক যে আলাদা তার
প্রমাণ এই যে (২০)-তে কিছু না বলাটা দীপেনের আর (২১)-এ রূপেনের নীরবতা। পুরাঘটিত
অসমাপিকা পরীক্ষায় তাহলে দেখা যাচ্ছে (১৬) থেকে (১৭)-য় যেতে মালিক বদলায়, (৮) থেকে
(৯)-এ যেতে বদলায় না।
মানে, যে বাক্যে নায়ক নেই সেখানেও অবশিষ্ট বৃত্তিগুলোর মধ্যে কোনো একটা
মোটামুটি এগিয়ে থাকে। সে একরকম উপনায়ক। এই সূক্ষ্ম খেলাটাতে (৮) আর (৯)-এ আশয়ের
তুলনায় প্রাপক এগিয়ে। তাই সে নায়কহীন নাটকের উপনায়ক হতে পেরে হাতে নিয়েছে চাবি।
মালিকের পদ অর্জন করে নিয়েছে সে। আশয়-স্বরূপ পাঁচটা রুটি তার সঙ্গে প্রাপ্য-প্রাপক
সম্পর্কে যুক্ত। এতে হয়তো তার পক্ষে সহজ হয়েছে আশয়কে সম্বল করে রেখে নিজে মালিক
হয়ে বসা। মনে রাখা দরকার মালিকত্ব কোনো গুণ নয়, অনেকগুলো সম্পর্কের সংযোগস্থল।
আচ্ছা, (৮)-এর সঙ্গে (৯)-এর তো প্রপাতসংস্থানের তফাত খুবই বেশি। (৮)-এর অভিধেয়
‘পাঁচ রোটিয়াঁ’; (৯)-এর ‘ছেলেটা’। ওদিকে (৯)-এ ‘পাঁচটা রুটি’ অবধেয়, আর (৮)-এ কোনো
অবধেয়ই হাজির নেই, ‘লড়কে কো’ তো প্রতিধেয়। (৯)-এ অভিধেয়ই যে মালিক, এটাকে ভাবতে
পারি (১) বা (২)-এর মতো সহজ উদাহরণের অনুরূপ। (৮)-এ যে অভিধেয় হয়েও ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’
সম্বলই থেকে গেল এ ব্যাপারটা নিয়ে কী বলা যায়? প্রপাতদের মধ্যে অভিধেয়র অগ্রগণ্যতা
কি (৮)-এর বেলায় কোনো কারণে খারিজ হয়ে গেল তাহলে?
খেয়াল করা দরকার, (৮)-এর মতো নায়কবিহীন বাক্যে আলাদা কোনো অবধেয় থাকে না। ফলে
বলতে পারি, এখানে নায়ক গায়েব হয়ে গিয়ে অভিধেয়ত্ব দিয়ে গেছে অবধেয়কেই। মানে,
নায়কহীন বাক্যে কোনো অভিধেয় যদি পাই তবে সে এক ‘অভি-অবধেয়’, যাকে আমাদের বিশ্লেষণে
বলেছি অভিধেয় আশয়। আসল অভিধেয়র দৃপ্ত অগ্রগণ্যতা নেই তার। তাকে ডিঙোবার মতো শক্তি
থাকলে অন্য কেউ এগিয়ে গিয়ে মালিক হতেই পারে। এখানে প্রাপক তাই করেছে।
হিন্দির সঙ্গে বাংলার তফাতটা এই যে, বাক্যের নায়ক যদি সরে দাঁড়ায় বা আদৌ না
থাকে, এবং আশয়ের তুলনায় এগিয়ে গিয়ে যদি প্রাপকই মালিক হয়, তাহলে আশয় সে বাক্যে
সম্বল হয়েও হিন্দিতে অভিধেয় প্রপাত পেয়ে যায়, যেমন ‘আপ কো কৌন চাহিয়ে?’ কিংবা (৮);
এটা আসলে এক মিশ্র অভি-অবধেয় প্রপাত, মানে এরকম অভিধেয়র পাশে প্রতিবেশী কোনো আলাদা
অবধেয় বসতে পারে না, আসন দুটো মিশে এক হয়ে যায়। বাংলায় এরকম বাক্যে আশয়কে হতে হয়
প্রতিধেয় (যেমন ‘আপনার কাকে চাই?’-এর ‘কাকে’) কিংবা বিশুদ্ধ অবধেয় (যেমন (৯)-এর
‘পাঁচটা রুটি’); তাকে অভিধেয়পনার অভিনয়ও করতে হয় না, কাজেই তাকে সম্বল বলে চেনা
যায় সহজে।
আর হিন্দির সঙ্গে বাংলার মিল এই যে এ ধরনের বাক্যে, অভিধেয়তা আশয়ে বর্তাক বা
না বর্তাক, আশয় সম্বলই থেকে যায়, মালিক হতে দেয় প্রাপককে। যে বাক্যে অগ্রগণ্য কেউ
নেই সেখানে একা আশয় যে বাধ্য হয়ে মালিকের আসনে বসে এটাও হিন্দি আর বাংলা দুই
ভাষাতেই হয় –
(২২) টেবল সে গিরকর কটোরী টূট গয়ী
(২৩) টেবিল থেকে পড়ে বাটিটা ভেঙে গেল
এখানে মালিক ‘কটোরী/ বাটিটা’-ই বাক্যের মূল কাণ্ডের সঙ্গে পুরাঘটিত
অসমাপিকান্ত শাখাকে যুক্ত করে। অথচ বাটি বাক্যটার নায়ক নয়, আশয়। মানে, নায়ক বা
প্রাপক কেউ না থাকলে আশয়ও উঠে দাঁড়িয়ে মালিকের দায়িত্ব নিতে রাজি থাকে। কিন্তু
এরকম মালিকের পিছনে সম্বল নেই বলে নিজের সম্বল সম্বল ভাব পুরো ঘোচে না। এর অভিধেয়
প্রপাতটারও অবধেয় ভেজাল টের পাওয়া যায় নানাভাবে। সে ভেজাল অবশ্য এই আলোচনার পরিধি-বহির্ভূত।
চার
মালিকের খোঁজে ঘোরাঘুরি করে যেটুকু বিদ্যে রপ্ত করেছি সেটা এবার সেইসব বাক্যে
ফলিয়ে দেখব যেখানে ব্যতিধেয় প্রপাতের বিভক্তি ‘নে’ হাজির আছে দেখে আমরা একটু থমকে
দাঁড়াই, আমরা যারা হিন্দির সঙ্গে কম পরিচিত।
(২) লড়কে নে পাঁচ রোটিয়াঁ খা লীঁ
পুরোনো দৃষ্টান্তকেই ফিরিয়ে আনলাম।
ব্যতিধেয় প্রপাতের ‘নে’-বিভক্তি ধারণ করে নায়ক
এখানে অভিধেয়তা ছেড়ে দিয়েছে আশয়কে। আশয় যে এমনিতে অবধেয়তার অধিকারী সেটা (১)-এ
স্পষ্ট। সেই অধিকার ছেড়ে না দিয়েই সে (২)-এ অভিধেয় প্রপাতটাকেও কব্জা করেছে। তাই
তার স্ত্রীলিঙ্গ বহুবচনের প্রতিফলন দেখি ‘খা লীঁ’ ক্রিয়াপদে। এ ধরনের অভি-অবধেয়
আশয় যখন নাটকের একমাত্র পাত্র তখন সে যে মালিকের দায়িত্বও নেয় সেটা (২২)-এ দেখেছি
বটে। কিন্তু (২)-এ ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’ মোটেই অমন একা নয়। অধিক্রমে, মানে
অধিকার-ভিত্তিক ক্রমে, তার স্থান এই বাক্যের নায়ক ‘লড়কে নে’-র নিচে। নায়ক অভিধেয়তা
থেকে সরে দাঁড়িয়ে ব্যতিধেয় প্রপাত গায়ে দিলে কী হবে, তার আধেয়গত বৃত্তি পালটায় নি।
সে এখনও নায়ক। এবং এই বাক্যে ক্রিয়া মালিক-বাচ্যে বা অ্যাকটিভ ভয়েসেই বহাল রয়েছে।
‘খা লী গয়ীঁ’-র মতো সম্বল-বাচ্যের বা প্যাসিভ ভয়েসের চেহারা হয় নি তার, অতএব
ক্রিয়ার মনোযোগে সম্বলের মধ্যে মালিক লীন হয়ে যায় নি (যেটা সম্বল-বাচ্যে ঘটবার
কথা)। ফলে ধরে নিতে পারি মালিক-বাচ্যের যে-কোনো স্বাভাবিক বাক্যের মতো বিশুদ্ধ
মালিক থাকবে। আর সম্বল থাকলে সে মালিকের থেকে আলাদা হবে। এ অবস্থায় (২)-এর আশয়
স্বভাবতই নায়ককে ডিঙোতে না পেরে সম্বল হয়েই সন্তুষ্ট থাকবে আর নায়কই মালিক হবে,
এটা প্রত্যাশিত।
পুরাঘটিত অসমাপিকা পরীক্ষাটা ব্যবহার
করলে দেখা যায় যে এরকম ধরে নিয়ে কোনো ভুল করি নি।
(২৪) ঘর লৌটকর লড়কে নে পাঁচ রোটিয়াঁ খা লীঁ
দেখতে পাই (২৪)-এ ছেলে বাড়ি ফিরছে এরকমই মানে দাঁড়াল। রুটি বাড়ি ফেরার
আভাসমাত্র এল না। ছেলেই যে মালিক এ বিষয়ে তাহলে সন্দেহ নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়
যে তার সঙ্গে রুটির মালিক-সম্বল-সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রয়েছে, ‘নে’-বিভক্তির এবং
প্রতিফলনের বিশেষ ব্যবস্থা সত্ত্বেও।
মূল ব্যাপারটা নিয়ে আশ্বাস পেলে
নিশ্চয়ই তারপর জানতে ইচ্ছে করবে, বিশেষ ব্যবস্থাটা কী এবং কেন। ‘কেন’-র প্রশ্নটা
এখানে তুলে লাভ নেই – অত বড় পটে তো ছবি আঁকতে বসি নি আমরা। তবে ব্যবস্থাটা কী, সে
আলোচনা করাই যায়।
ব্যতিধেয় প্রপাতের ‘নে’-বিভক্তি ধারণ
করে মালিক যেন ক্রিয়াকে বলছে, আমি তোমার মালিক সেটা দেখাবার জন্যে এমনিতে তোমাকে
যে ওঠবোস করাই সেই ব্যায়াম করতে তুমি এ বাক্যে বাধ্য নও, আমি নিজেই ব্যতিধেয়
প্রপাতের ‘নে’-তকমা গায়ে এঁটে নিয়েছি যাতে বোঝা যায় আমি সম্বলওয়ালা মালিক। তুমি
বরং গিয়ে সম্বলের সঙ্গে খেলা করো গে। আর সম্বলকে বলছে, তুমি যদি অভিঅবধেয় সেজে
ক্রিয়াকে প্রতিফলন করাতে চাও তো সে খেলা খেলতে পারো, তবে তোমার প্রতিধেয় পোশাকটা
পরতে চাইলে সেটাকে বাঁচিয়ে রেখো, খেলাধুলো এড়ানোই ভাল। মোট কথা, আমার আজ ক্রিয়ায়
সঙ্গে কোনো কাজ নেই। এইসব বলে মালিক নিজের অভিধেয়তা দিয়ে যায়, সম্বলের ইচ্ছে করলে
নিতে পারে। সম্বল তখন অভি-অবধেয় হিসেবে সেটাতে দখল বসাতে পারে, যার দৃষ্টান্ত (২),
(৫) আর (২৪)।
ব্যতিধেয়-বিশিষ্ট বাক্যে সম্বলের
পক্ষে বিশুদ্ধ অবধেয় হয়ে থাকা সম্ভব নয়, মানে (৫)-এর বদলে বাক্যটার চেহারা ‘রাকেশ
নে বিল্লী দেখা’ হতে পারে না (ক্রিয়ার নিরপেক্ষ চেহারা ‘দেখা’ যদি বৈধ হত তাহলে
আমরা ‘বিল্লী’-কে বিশুদ্ধ অবধেয় বলে ধরতে পারতাম)। সম্বলকে হয় (৫)-এর ‘বিল্লী’-র
মতো মেশানো অভিঅবধেয় হতে হবে, নয়তো (৬)-এর ‘বিল্লী কো’-র মতো বিশুদ্ধ প্রতিধেয় হয়ে
খেলাটার বাইরে থাকতে হবে। তার কারণ, ক্রিয়া প্রথমে অভিধেয় বেছে নেয়, মানে ঠিক করে
কাকে প্রতিফলন করবে, তারপর ভেবে দেখে কাকে অবধেয় হিসেবে পুষবে কিংবা আদৌ পুষ্যি
নেবে কিনা। কোনো অভিধেয় ঠিক না করে সে আপন মনে অবধেয় রাখতে পারে না। একা অবধেয় বলে
কিছু হয় না, অবধেয়র সত্তা অভিধেয়নির্ভর। মালিককে অভিধেয় হিসেবে না পেলে ক্রিয়াপদ
বাংলায় ‘রিক্ত’ অভিধেয় নিয়োগ করে আর হিন্দিতে অভিধেয় আর অবধেয়র আসন দুটোকে এক করে
দেয় – মানে, যে অবধেয়কে সে আশ্রয় দিচ্ছে, তাকেই প্রতিফলন করে সে আবার অভিধেয়র
আসনেও বসায়।
হিন্দির সঙ্গে বাংলার এই তফাত
(২২)-এর দুয়েক অনুচ্ছেদ আগের আলোচনায় লক্ষ করেছিলাম। তফাতটা ব্যতিধেয় বাক্যের
বেলাতেও প্রাসঙ্গিক। একমাত্র (৬)-এর মতো বাক্যেই হিন্দি কোনো আসল অভিধেয় বা অবধেয়
না পেয়ে বাধ্য হয়ে রিক্ত অভি-অবধেয় রাখে। কিন্তু ‘আপনার কাকে লাগবে’-র মতো বাংলা
বাক্যে মালিক উদ্ধেয় প্রপাতে চলে যায় এবং ক্রিয়াপদ রিক্ত অভিধেয় নিয়োগ করে তৃতীয়
তরফ সামান্য গৌরবের রূপ ধারণ করে, যেটা ‘লাগবে’-র মতো নিয়মানুগ ক্রিয়ার বেলায়
সুস্পষ্ট (‘আপনার কাকে চাই’-এর ব্যতিক্রমী ক্রিয়া ‘চাই’ সেজন্যে খুব জুতসই
দৃষ্টান্ত নয়), এবং সম্বলকে তার স্বাভাবিক প্রপাত বেছে নিতে দেয়। এখানে সেটা
‘কাকে’-র প্রতিধেয় প্রপাত, আর ‘আপনার কী বই লাগবে’-র বেলায় অবধেয় প্রপাত; মানে,
মোটের উপর ‘আপনি কাকে খুঁজছেন’ বা ‘কী বই খুঁজছেন’-এর মতো বাক্যে যে “সাধারণ”
সম্বলের দেখা পাই তার উপযুক্ত প্রপাত। এই ধরনের অবধেয় প্রপাতে অভিধেয়র কোনো ভেজাল
থাকে না, হিন্দি আশয়ের ক্ষেত্রে যা থাকে। ফলে, বাংলায় ‘আপনার কে লাগবে’-র মতো
বাক্য গঠিত হয় না – ওই ধরনের বাক্য যদি সম্ভব হত তাহলে ‘আপ কো কৌন চাহিয়ে’ জাতীয়
হিন্দি বাক্যের তুলনীয় বলে গণ্য হত।
পাঁচ
ভাষা বিশ্লেষণের যে রীতি এই প্রবন্ধে অনুসৃত হয়েছে তার চেয়ে অনেক প্রাচীন অন্য
এক তত্ত্বের অল্পবিস্তর পরিচয় অনেক পাঠকই পেয়েছিলেন বাল্যে, বিদ্যালয়ের ব্যাকরণ
চর্চায়। তাতে ছিল কর্তা কর্ম করণাদি ষট্ কারকের সঙ্গে প্রথমা দ্বিতীয়া প্রভৃতি
সাতগুচ্ছ বিভক্তির সমন্বয়ের জটিল কাহিনি। সেই কারকতত্ত্বের ভাষায় বলা যেত, (২৫)-এর
মতো বাক্য যদি কেউ রচনা করেন –
(২৫) আপেলটা তুমি এই ছুরি দিয়ে কেটো
– তাহলে সেই বাক্যে তুমি ‘কর্তা’, আপেল ‘কর্ম’, ছুরি ‘করণ’। সেকালে অনেকের
মাথায় এই বাল্যশিক্ষার রেশ রয়ে যেত বলে পাঠকমহল ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’-জাতীয়
বাচনভঙ্গিতে সাড়া দিতেন, যদিও কর্তন করাটাই যে (২৫)-এর বেলায় ‘ক্রিয়া’ বলে
বর্ণিতব্য এবং ‘কর্ম’ যে এখানে কর্তন নয়, আপেল, এইসব খুঁটিনাটি একটু ধোঁয়াটে রয়ে
যেত।
আসলে ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ কথাটাতে
তো ক্রিয়া অর্থে ‘কর্ম’ বলা হচ্ছে – কর্ম শব্দের যেটা স্বাভাবিক অর্থ তার সঙ্গে
সেটা পুরোপুরি খাপ খায়। কিন্তু ব্যাকরণে (২৫)-এর মতো বাক্যে যে বেছে বেছে আপেলকেই
‘কর্ম’ বলা হয় এই বিদঘুটে পারিভাষিক বাস্তবের সঙ্গে কথাটার ওই প্রচলিত প্রয়োগকে
মিলিয়ে চলা খুবই কঠিন ছিল। তাই ওই ধরনের পরিভাষার কাব্যগুণ বা প্রসাদগুণ টুণ যতই
থাকুক না কেন, ওরে ঠিকমতো আন্তর্বৈষয়িক বিতর্ক বা আলোচনা চালানো যেত কিনা সন্দেহ।
চালানোর চেষ্টাও বেশি হয় নি।
তাছাড়া, আজকের দিনের যেসব সাধারণ
শিক্ষিত বাঙালির মনোজগতের সাধারণ্যে নতুন নতুন পথে চিন্তাসূত্র গুছিয়ে নেবার বড়
রকমের চেষ্টা চলছে, তাঁদের স্বাভাবিক ভাবনার নাগালের বাইরে চলে গেছে ‘অপাদান, করণ,
অধিকরণ’-এর মতো পারিভাষিক সরঞ্জাম। আজকের দিনে ‘কর্ম’ বলতে সবাই যা বোঝে তাতে
(২৫)-এর মতো বাক্যে কয়েদিকে ‘কর্ম’ ভাবতে রীতিমতো কষ্টকল্পনার দরকার পড়ে। ‘কর্তা’-ও
চিন্তাগ্রাহ্য ধারণা হিসেবে মৃতপ্রায়। আর সম্প্রদান কথাটার যেটুকু মানে বাকি আছে
তাতে ‘ভিখিরিকে পয়সা দিচ্ছে’ বাক্যে ভিখিরিই ‘সম্প্রদান’ এ কথা ভাবতে বেশ জবরদস্তি
করতে হয়। এই তো অবস্থা। আজকের দিনে কর্তা কর্ম করণাদি কারকের নাম অথবা সংস্কৃত
শব্দরূপের লাইনগুলোর অনুক্রম ধরে প্রথমা দ্বিতীয়াদি বিভক্তিগুচ্ছের নাম বাংলা
ব্যাকরণের আলোচনায় সচল থাকবে এই ব্যবস্থা করা খুবই শ্রমসাধ্য; এবং এর সপক্ষে
জোরালো যুক্তি না থাকলে সেই শ্রম পণ্ডশ্রম।
বাক্যতত্ত্বের সব কর্মীই স্বীকার
করেন যে কারকভিত্তিক চিন্তাব্যবস্থায় বাংলা বাক্যের বিশ্লেষণের কাজ চলে না।
কারকভাষ্যের পক্ষে যুক্তি তো নেইই, বরং বিরুদ্ধে যুক্তি রয়েছে।
কারকতন্ত্রেই জোড়াতালি দিয়ে বাংলার
কাজ চালাবার চেষ্টা হয়েছে শতাধিক বছর ধরে। সে চেষ্টায় সাফল্যের আশা যে নেই সেটা আজ
স্পষ্ট। তাই এমন নতুন ধারণাতন্ত্র গড়ে তোলা দরকার যা দিয়ে ঠুকঠাক কাজই শুধু চলবে
না, যার কাছ থেকে আরেকটু বেশি প্রত্যাশাও করতে পারি। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সঙ্গে
বাঙালিদের যোগাযোগের প্রধান দুই মাধ্যম হিন্দি আর ইংরিজি। অন্তত সেই দুটো ভাষার
সঙ্গে আমাদের সামান্য যে কারবার তারও যাতে খানিকটা সুরাহা হয় সেটা দেখতে হবে। এমন
ধারণাতন্ত্র চাই যা বাংলা বাক্যতত্ত্বের কাজেও লাগবে, আর হিন্দি বা ইংরিজি নিয়ে
বাংলার মাধ্যমে যে চিন্তা করা দরকার সেটা গুছিয়ে নিতেও সাহায্য করবে।
বর্তমান প্রবন্ধে ব্যতিধেয়-বিশিষ্ট
বাক্যের সমস্যা নিয়ে যে আলোচনা করা হল তার ভিত্তিতে অন্যান্য নব্য ভারতীয়-আর্য বা
‘তদ্ভব’ ভাষার বাক্যতত্ত্বের পরিচয় পাবার পথ খানিকটা সুগম হতে পারে। গুজরাটি
মারাঠি পাঞ্জাবি সিন্ধি কাশ্মীরি নেপালি ইত্যাদি অনেক নব্য ভারতীয়-আর্য ভাষায়
ব্যতিধেয় প্রপাত সংবলিত বাক্যের গতিপ্রকৃতি হিন্দির কাছাকাছি। (ওড়িয়া বা অসমিয়ার
মতো যেসব ভাষা বাংলার নিকট আত্মীয় তাদের অবশ্য ব্যতিধেয় প্রপাত নেই।) সেদিকে এগোতে
চাইলে প্রথমে হিন্দিটা বুঝে নিলে সুবিধে। এবং সেইমতো সরঞ্জাম তৈরি করা দরকার।
ভাষাবিজ্ঞানীদের
কাছে এটা অনেক দিন আগেই স্পষ্ট হয়েছে যে পাণিনি-প্রবর্তিত কারকতত্ত্ব তার
আশ্রয়ভাষা সংস্কৃতের পক্ষে যতটা উপযোগী ছিল, নব্য ভারতীয়-আর্য ভাষাগুলোর বেলায়
ততটা কাজের নয়। বিশেষ করে ব্যতিধেয় প্রপাতের কাহিনি কারকতত্ত্বের ভাষায় আদৌ বলা
কঠিন এবং ঠিকমতো বলা একেবারেই অসম্ভব। বলতে চাইলে ভেঙে মুচড়ে প্রচণ্ড জটিল করে
নিতে হয় তন্ত্রটাকে। তার চেয়ে অনেক কম কষ্টকল্পনা করে আনকোরা নতুন বাক্যতত্ত্ব
রচনা করা যায়। সেই রচনার চেষ্টা করা হচ্ছে কিছু দিন ধরে। পৃথিবীর নানা ভাষার চোখে
চোখ রেখে যে তুলনামূলক বাক্যতত্ত্ব ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে – সঞ্জননী ব্যাকরণের
কর্মীদের হাতে – সেই গবেষণা-ধারার একটা দিক তুলে ধরেছি এই প্রবন্ধে।
আরো একটা কথা এখানে খুলে বলার
দরকার থাকতে পারে। হিন্দি বাক্যের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে কিছু সূত্র সাজিয়েছিলাম
বছর পঁচিশেক আগে – বিশেষজ্ঞদের অঙ্ক কষা আকরণে। আমার সেই লেখার ভিত্তিতে একটা
কর্মশালায় কিছু ছাত্রকে কষে দেখিয়েও দিয়েছিলাম বিশ্লেষণের আকরণিক আদল। সেইসব
সূত্রের খেই ধরেই তারপর ব্যতিধেয়-টেয় সমেত হিন্দি বাক্যের আকরণিক গল্পটা খুলে বলার
কাজে হাত দেয় সেই কর্মশালার এক ছাত্র (ততদিনে সে চমস্কির কাছে গবেষণা করছে)। তার
করা হিন্দির বিশ্লেষণের অভিঘাতে আন্তর্জাতিক বাক্যতত্ত্বের কিছু কিছু জরুরি রদ-বদলও
ঘটে – বাক্যতত্ত্বের আলোচনার ধারা তারপর থেকে নতুন খাতে বইতে থাকে। তা, আমার সেই
আকৃত, হিসেব-নিকেশে ভরতি পরিস্ফুটনে যা কষে দেখিয়েছিলাম, সেই বিশ্লেষণটারই একটা
অবিশেষজ্ঞদের বুঝিয়ে বলা চেহারা পাচ্ছেন আপনারা বর্তমান প্রবন্ধে। মোদ্দা গল্পটা
একই। যাঁরা পুরো হিসেব চাইবেন তাঁরা নিশ্চয়ই ধাপে ধাপে সঞ্জননী ব্যাকরণের সরঞ্জাম
আয়ত্ত করে নেবেন। অতদূর না গেলেও আমাদের অনেকের চলবে; এখানে আমার কারবার প্রধানত
সেই দলের সঙ্গে।
এখানে প্রস্তাবিত ধরনের অপাণিনীয়
পথে চলতে শেখা আমাদের পক্ষে আজ জরুরি। পুরোনো হয়ে যাওয়া যে ধারণাগুলোকে রাখতেও
পারছি না, ফেলতেও পারছি না, তাদের বিড়ম্বনা থেকে এই পথে মুক্তি পেতে যাঁরা চাইবেন
না তাঁরা যে যার নিজের রাস্তা খুঁজবেন – সেই অন্বেষণকেও আগাম স্বাগত জানিয়ে রাখছি।
ব্যাকরণে চিরকালই নানা মুনির নানা মত; কোনো চূড়ান্ত রায় দেবার সময় কখনো আসবে কিনা
কেউ জানে না, এখনও যে আসে নি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বলা বাহুল্য, কারকতন্ত্রকে
পরিত্যাগ করা মানে ওই তন্ত্রের সঙ্গে অন্য তন্ত্রের মিল আর তফাত ভাল করে বুঝে
নেওয়া। বিশেষ করে যে পাঠকরা কারকভাষ্যের সঙ্গে আবাল্য পরিচিত তাঁরা নিজেদের গরজেই
জেনে নিতে চাইবেন বর্তমান ভাবনার সূত্রের সঙ্গে শাস্ত্রীয় চিন্তার কোথায় মিল,
কোথায় প্রভেদ।
মেরে কেটে (১০)-এর স্থল, উৎস, উপায় এই তিনটে বৃত্তির সঙ্গে অধিকরণ, অপাদান, করণ এই কারকগুলোকে মেলানো
যায়। আর সম্প্রদান কারককে লক্ষ্য, প্রাপক, উপপ্রাপক আর ভোগীর নিছক যোগফল বলতে
ইচ্ছে করলেও বলা কেন চলে না, কারকতন্ত্র বিষয়ে অবহিত পাঠক তার খানিকটা এমনিতেই
জানেন, বাকিটা বর্তমান প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু নায়কের সঙ্গে
কর্তাকে বা আশয়ের সঙ্গে কর্মকে মিলিয়ে সমান বলে দেখাতে গেলে বেশ বড় গোলযোগ বাধবে। যেমন,
(৮) সংখ্যক বাক্যের ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’-কে পাণিনীয়রা কর্ম না বললেও আধুনিক তত্ত্ব আশয়
বলেই ধরবে – অথচ ওটা পাণিনীয় মতে কর্তার দৃষ্টান্ত।
পাণিনীয়রা
যাকে কর্তৃ-বাচ্য আর কর্ম-বাচ্য বলেন তার সঙ্গে আমাদের মালিক বাচ্য আর সম্বল বাচ্য
মোটামুটি মেলে। তবে যাচাইয়ের কষ্টিপাথর আলাদা। পাণিনীয়রা প্রশ্ন করেন, ক্রিয়াপদ কাকে
অভিধেয় করল? কর্তাকে করলে কর্তৃ-বাচ্য, কর্মকে করলে কর্ম-বাচ্য। আধুনিকদের প্রশ্ন
হল, ক্রিয়া কি মালিককে স্বতন্ত্র রাখছে, ধরে নিচ্ছে যে সম্বল থাকলে তার সঙ্গে
মালিকের তফাত থাকবে? (তাহলে মালিক-বাচ্য।) নাকি মালিকের সঙ্গে সম্বলকে মিশিয়ে দিয়ে
সম্বলকেই করে তুলছে একাধারে ‘মালিক তথা সম্বল’? (সেক্ষেত্রে সম্বল বাচ্য।)
এই দু ধরনের প্রশ্ন যে প্রায়ই
শেষমেশ সমান্তরাল উত্তরে পৌঁছে দেয়, তার নাটকীয় দৃষ্টান্ত (৮)। আধুনিক ভাষ্য এই
বাক্যে মালিক স্বীকার করে, কারণ মালিক ‘লড়কে কো’-র সঙ্গে সম্বল ‘পাঁচ রোটিয়াঁ’-র
তফাত স্পষ্ট। পাণিনীয় দৃষ্টিও যে (৮)-এ কর্তৃ-বাচ্য দেখতে পায় তার কারণ কিন্তু
‘পাঁচ রোটিয়াঁ’ শাস্ত্রীয় মতে কর্তা! ‘লড়কে কো’-কে পাণিনীয়রা সম্প্রদান (অথবা
মতান্তরে বিশেষ জাতের কর্ম) বলতে বাধ্য। ফলে পাণিনীয়রা (১৯)-এর ব্যাখ্যা দিতে
পারেন, (১৮)-র পারেন না। আধুনিক পদ্ধতির অন্যতম সুবিধে হল (১৮) আর (১৯) দুটোর
বেলাতেই সন্তোষজনক বিশ্লেষণ দিতে পারা।
কর্তৃ আর কর্ম-বাচ্যের ভাষ্য থেকে
মালিক-বাচ্য সম্বল-বাচ্যের ভাষ্য যে অনেকটা আলাদা এটা সবচেয়ে স্পষ্ট হয় সেইসব
বাক্যে যেখানে ব্যতিধেয় প্রপাত আছে এবং আশয় অভিধেয়, যেমন (২) বা (৫)। (৫)-এর মতো দৃষ্টান্তে
আধুনিক তত্ত্ব মালিক বাচ্যই দেখতে পায়; এর সঙ্গে (৬)-এর মিল দেখাতেও বেগ পায় না;
এবং (২৪)-এর মতো বাক্যের তৃপ্তিকর ব্যাখ্যা দিতে পারে। কিন্তু পাণিনীয় দৃষ্টি
(৫)-এ কর্ম-বাচ্য স্বীকার করতে বাধ্য, (৬)-এ তার সঙ্গে একেবারে অসম্পৃক্ত
ভাব-বাচ্যের কথা এনে ফেলে, এবং (২৪)-এর রহস্যভেদে অপারগ।
কারকতত্ত্বের
একটা মস্ত সমস্যা হল কর্তা আর কর্মের ধারণায় একই সঙ্গে বাক্যতাত্ত্বিক বৃ্ত্তি এবং
আধেয়গত বৃত্তি প্রকাশ করার চেষ্টা। বর্তমান তত্ত্ব মালিক আর সম্বলকে আপেক্ষিক
গুরুত্ব বা অগ্রগণ্যতার মাপকাঠির সাহায্যে শনাক্ত করে – বাক্যতাত্ত্বিক বৃত্তি
হিসেবে – এবং প্রাপক নায়ক আশয় এসমস্ত আধেয়গত বৃত্তিকে ঘটনার পাত্রপাত্রী নির্দেশের
পর্যায়ের ধারণা বলে গণ্য করে। এক দিকে আধেয় আর অন্য দিকে প্রপাতচিহ্নিত আকৃতির
মধ্যেকার সম্পর্কজালে বাক্যতত্ত্বকে বিধৃত রেখে আধুনিক ভাষ্য অপেক্ষাকৃত পরিস্ফুট
রীতিতে ভাষার বিভিন্ন স্তর নিয়ে এমন বিশ্লেষণ দিতে পারে যা প্রাচীন নবীন অনেক
ভাষার নানারকম সমস্যার জট ছাড়িয়ে দেয়।
এসব তো দুই ভাষ্যের তফাতের কথা
বললাম। একটা বড় মিলও আছে। প্রাচীন আর নবীন উভয় ভাষ্যই বাক্যের আস্ত চেহারাটা
স্পষ্ট চেখতে পায়। তাই কেউ যদি বাহুল্যবোধে বাক্যের কোনো অংশ মুখে নাও বলে, যেমন
কেউ যদি (১) আর (২)-এর বদলে স্রেফ ‘পাঁচ রোটিয়াঁ খা লেগা’ অথবা ‘পাঁচ রোটিয়াঁ খা
লীঁ’ বলে, তাহলে ধরে নিতে পারি বক্তা জানে যে শ্রোতা বুঝে নেবে ‘লড়কা’ কিংবা ‘লড়কে
নে’ অংশটুকু উহ্য রইল। তাই বলে প্রাচীন বা নবীন কোনো ব্যাকরণতত্ত্বই এমন আজব কথা
বলবে না যে ‘পাঁচ রোটিয়াঁ খা লেগা’ বাক্যটাতে নায়ক বা অভিধেয় নেই। আছে নিশ্চয়ই –
চক্ষুকর্ণগোচর নয় তাতে কী, মানসগোচর তো বটে! এটা ছিল প্রাচীনদের অভিমত। আধুনিকরা
এই মতেরই একটা জটিল, সমৃদ্ধ পরিস্ফুটন রচনা করেছেন। এখানে সে কথায় কাজ নেই। তবে খবরটা
হয়ত জেনে রাখা ভালো। বলা বাহুল্য, বর্তমান প্রবন্ধ যেখানে যে বাক্যের কথা তুলেছি, প্রত্যেক
বারই বাক্যের প্রাসঙ্গিক অংশ চাক্ষুষ হাজির ছিল। ব্যাকরণের আলোচনায় এইরকমই রীতি।
কিন্তু আটপৌরে ব্যবহারে বাক্যের নানা অংশ বাহুল্যবোধে বাদ দিই, শ্রোতা বুঝে নেবেন
বলে। সেই বাদ দেওয়াটারও ব্যাকরণ আছে। তার হিসেবও বৈয়াকরণদের জানা, প্রাচীন নবীন
দুই তত্ত্বেই। তবে বর্তমান আলোচনায় সেই হিসেবের খুঁটিনাটি কষতে বসি নি। প্রথমে
আস্ত বাক্যের ব্যাকরণের চর্চা করাই ভালো। ভাঙা বাক্যের কথা নাহয় অন্যত্র হবে।
ছয়
ভাষাবিজ্ঞানের বাইরে অন্যান্য মহলে যাঁদের কাছে সাবজেক্ট বা মালিক আর অবজেক্ট
বা সম্বলের মতো ধারণার গুরুত্ব আছে তাঁরা বর্তমান আলোচনার কী কী সূত্র ব্যবহার
করতে চাইবেন অথবা কী কী জায়গায় সংশয় বোধ করছেন, সেসব কথা নিশ্চয়ই নিজে থেকে
তুলবেন। ভাষাবিজ্ঞানীর কাজ খালি দেখিয়ে দেওয়া যে ব্যাকরণের নিজস্ব কিছু ব্যাপৃতি
অন্যদের কাছেও বিশেষ আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
সাবক কালের সমাজ খুঁজেছিল রাজার
মতো অথবা গুরুর মতো মালিককে। প্রজা বা শিষ্য ছিল আদর্শ সম্বলের প্রতিমূর্তি।
আধুনিক সমাজ বলেছে সবাইকে মালিকের ভূমিকায় আনবার ব্যবস্থা করা হবে। এরই নাম নাকি
গণতন্ত্র। ক্রমশ দেখা যাচ্ছে সবাইকে মালিক করে কোনো সংসার চালাতে কেউ শেখে নি। তাই
আজ অনেকে নতুন পথ খুঁজছে। এই সন্ধানের সূত্রেই বর্তমান প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নিয়ে
কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক।
এই আলোচনা থেকে হয়তো স্পষ্ট হল যে
নায়কতার আধেয়র সঙ্গে অভিধেয়তার আকৃতিকে মিলিয়ে বাক্যে একটা খেলা চলতে থাকে। তার
মাঝখান দিয়ে মালিক আর সম্বলের সম্পর্কও আস্ত থাকে, সংসারও দিব্যি চলে। কিন্তু কোনো
নির্দিষ্ট আধেয়র বা আকৃতির বৃত্তিকে সমস্ত মালিকের অথবা প্রত্যেক সম্বলের ভূমিকা
বলে চিরতরে বেঁধে দেওয়া যায় না। সেরকম কঠিন নিরূপণ বাক্যতত্ত্বের স্বভাববিরুদ্ধ।
ভাষাভেদেও তারতম্য আছে, কালভেদেও তফাত হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ক্রিয়াপদের বিভিন্ন
ঝোঁক। মানে আকৃতির আর আধেয়র বৃত্তিগুলো নানা ভূমিকায় নেমে, বিভিন্ন অংশগ্রহণ করে,
নাটকটাকে জমিয়ে তোলে। ঠিকমতো জমে উঠলেই সংসারের চাকা ঘোরে, যাকে বলে সংসারচক্র।
তখন মালিক নির্বাচনের আইন-কানুন নিয়ে দুর্ভাবনার দরকার ঘুচে যায়।
তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়াল, ঠিকমতো অংশ
যে গ্রহণ করব, সমাজকে যে জমিয়ে তুলব, এ খেলার রীতি বুঝব কী করে? কিসের অংশ, কীভাবে
গ্রহণ? সমাজের খেলাকে বাক্যের প্রতিরূপ বা বিবর্ধন ভাবা নিশ্চয়ই সরলীকৃত উপমা
মাত্র। কিন্তু সমাজের মতো মস্ত বড় জরুরি ব্যাপারকে বুঝবার চেষ্টায় লোকে তো নানাবিধ
উপমা আর রূপকেরই সাহায্য নেবে। বাক্যের নাটক বা খেলাটাকেও নাহয় সমাজের আরেকটা রূপক
বলেই ভাবলাম। এদিক থেকে যদি সমাজের দিকে তাকাই তাহলে হয়তো বিশেষ কিছু শিখতে পারব
বা দেখতে পাব যা এমনিতে চোখে পড়ে না।
সেভাবে যদি কপাল খুলে যায়, তাহলে
ব্যাকরণকে আকৃতিসর্বস্ব অথবা সমাজবিমুখ বিষয় বলে ভাববার ঝোঁকটাও আজকের মতো এতটা
জোরদার নাও থাকতে পারে। একই রুচি, একই অরুচি কি আর চিরকাল চলে?