Sunday, December 16, 2012

Goddo o Bonkimcandro: Ubhoshanketoner prostaabona: COTURTHO KISTI


।।বঙ্কিম আবার কোথায় এসব বললেন।।

ভাষার আর বাচকতার কী আদল মাথায় রেখে কাজ করছেন সে বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র কিছুই গোপন করেননি। উপন্যাসের গোড়াতেই লিখেছেন “৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন।” এভাবে ঐতিহাসিক স্থানাঙ্কে নায়কের অবস্থান নির্দেশ করেই তৎক্ষণাৎ বঙ্কিম তাকে নিক্ষেপ করেন এক অনির্ণেয় মধ্যভূমিতে। সেখানে সীমারেখার প্রহরী অনুপস্থিত বলে কুশীলবের পক্ষে মৌল প্রশ্ন নিয়ে কথা বলা সম্ভব। দ্বিতীয় পৃষ্ঠাতেই বিমলাকে বলতে শুনি, “স্ত্রীলোকের পরিচয়ই বা কী?” তখনও পরিচয়-না-দেওয়া জগৎসিংহের নীরবতা জ্ঞাপনের ধরনটাও নজর টানে: “যুবক একথার উত্তর করিলেন না। তাঁহার মন অন্যদিকে ছিল।”
   মন যে বিভিন্ন দিকে ধাবিত হয়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রবাহও মনোযোগ দাবি করে যে দরবারি কর্মসূচির প্রতিস্পর্ধী হয়ে দাঁড়ায়, এই তত্ত্বকথা বঙ্কিম কীভাবে পাঠকের চেতনায় পৌঁছে দেন? আয়েষা-তিলোত্তমা-জগৎসিংহের ত্রিকোণ সরাসরি এ কাজ করছে বললে অত্যুক্তি হবে। তবে কি বিবিধ দৃষ্টিকোণের বিভিন্নতার উপর জোর দেবার জন্যে তিনি ভাষার যে অসমসত্ত্বতার আশ্রয় নেন সেটাও আখ্যানেরই শুধু নয়, কুশীলবের মনোযোগের স্তরভেদ ফুটিয়ে তোলার অন্যতম সরঞ্জাম বলে গণনীয়?
      দৃষ্টিকোণ বলতে আমি খালি কুশীলবের নানারকম চোখের কথাই বলছি না। লেখক যেখানে ত্রিকালদর্শী সর্বত্রগামী আখ্যায়ক হিসেবে পাঠককে প্রত্যক্ষ সম্বোধন করছেন সেসব জায়গাও প্রণিধানযোগ্য। দরকারমতো ঐতিহাসিক বাচকতার কণ্ঠস্বরের আশ্রয় নিয়ে বঙ্কিম স্থানাঙ্ক নির্দেশের জ্যামিতিতে ফিরে যেতে রাজি থাকেন। দ্বিতীয় খণ্ডের অষ্টাদশ পরিচ্ছেদে যখন লিখছেন, “সন্ধির বিস্তারিত বিবরণ ইতিবৃত্তে বর্ণনীয়, এ স্থলে অতি-বিস্তার নিষ্প্রয়োজন”, ততক্ষণে পাঠক ভাল করেই জানেন, “এ স্থলে” বিস্তারে বা সংক্ষেপে কী কী পেশ করার প্রয়োজন হয়েছে। একটু খুলেই বলি।
তিলোত্তমার পাওয়া, আয়েষার চাওয়া আর না পাওয়া, এই পরিণামের ক্রমবিকাশের পথে পাঠকের সংবেদ একবার ঝুঁকেছে তিলোত্তমার দিকে, একবার আয়েষার দিকে। ক্রমশ পাঠক বুঝতে শিখেছেন যে তাঁর নিজের রুচির পাল্লা যার দিকেই ভারি হোক না কেন, বড় মাপের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপদ আছে, যেকোনো পক্ষকেই ঝুঁকি নিতে হয়, ঝুঁকি নিতে পারা আর প্রয়োজন হলে পরাজয় স্বীকার করেও তার পরে বিশ্বসংসারের উপর আস্থা না হারানোই বীর পুরুষেরও লক্ষণ, আয়েষার মতো বীর রমণীরও।
পাঠক তাছাড়া খুব পরিষ্কার দেখতে না পেলেও আবছা অনুভবে বুঝতে পেরেছেন যে, ব্যক্তিগত আবেগের ব্যাপারে তিনি একেকজনের ব্যথায় সমব্যথী হতে সহজেই পারছেন ঠিকই; কিন্তু পক্ষপাতাস্পদ ব্যক্তিদের কোনটা সাময়িক প্রৈতি আর কোনটা স্থায়ী দায়বদ্ধতা সেসব তফাত লক্ষ করে নিষ্ঠাবানের প্রতি নিষ্ঠা রক্ষা করা পাঠক হিসেবে তাঁর পক্ষেও আয়াসসাধ্য। সেই চেষ্টা করতে করতে তাঁর নিজেরও বিবেচনাশক্তি ক্রমশ সুপরিণতির পথে এগিয়ে চলে।
উপন্যাসে চিত্রিত ব্যক্তির রাষ্ট্রীয় চয়নের ব্যাপারে নিষ্ঠা অর্জনই বলুন, সামাজিক অবস্থানের সূক্ষ্মতা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিই বলুন, ব্যক্তিগত রুচি আর আকৃষ্টতার ঘাত প্রতিঘাত সামলে নিজেকে আর নিজের দয়িত বা দয়িতাকে চিনে নিতে নিতে এগিয়ে যাবার পথ খুঁজে নেওয়াই বলুন – উপন্যাসের কুশীলবের এই বহুতল কাহিনির বোদ্ধা তথা বিচারশীল পাঠক হয়ে ওঠার কাজটা আসলে বেশ কঠিন। ওই আয়াসসাধ্য কাজটাই যে গণতান্ত্রিক মেজাজের শিক্ষালাভেরও জায়গা একথা বঙ্কিম বানান করে শিখিয়ে দেন না। ইঙ্গিতে দেখিয়ে দেন।
পাঠকের অগোচরেই এভাবে গণতান্ত্রিক নাগরিকত্বের বহুতল শিক্ষানবিশির ব্যবস্থা শুরু হয়ে যায় বঙ্কিমের গদ্যে। পাঠক টের পান যে তাঁর আনুগত্যের উপর যেকোনো অলঘু প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একাধিক পক্ষেরই ‘বৈধ’ দাবি আছে। একবার এদিকে, একবার ওদিকে পক্ষপাত পোষণ করতে করতে পাঠক ক্রমশ দেখতে পান ছবিটা কতখানি ব্যাপক, দেখতে পান সেই ‘বৈধতা’র রকমফের আছে তার কারণ কোন ‘বিধি’র বিধানে কে চলবে তা নিয়ে ঠেলাঠেলি চলতেই থাকে। সে দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত জায়গাটা জমকালো রাজনীতির রাজধানীমনস্ক ব্যাপার হলেও অনেকগুলো অচূড়ান্ত দরকষাকষিও চলে, সেইগুলোকে ঘিরেই বেশি টানাপোড়েন। বিশেষ একজন মেয়ে অমুক ছেলের মন পাবে কিনা এরকম কোনো নি-‘ছক’ প্রশ্নকে ঘিরে তো আর সে-মেয়ের অভিজ্ঞতা সেজে ওঠে না। ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের নেপথ্যে সবসময়ই নানাবিধ শক্তি বৃহত্তর মানচিত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ছক ছকতে থাকে। সেসব ছকের ছায়া পড়ে বলেই ব্যক্তিগত ঘাত-প্রতিঘাতের অর্থ নির্ধারণে সামাজিক-ঐতিহাসিক স্থানাঙ্কের জ্যামিতিও মিশে যায়, যে জ্যামিতির কিছু দিক রাজনৈতিক।
বিভন্ন ছকের অনুধাবন বঙ্কিমের উপন্যাসে সাজানো থাকে প্রধানত বিচক্ষণ স্ত্রীচরিত্রের বুঝতে পারার জায়গাটাতে। বহুতল বাস্তবের এই জটিলতা-মনস্ক অনুধাবন ফুটিয়ে তুলবেন বলে বঙ্কিম নানা ঢঙের কথাবার্তা এনে ফেলেন তাঁর সংলাপে। আখ্যানেও তিনি বিভিন্ন রুচির প্রতিনিধিত্বের পরিস্ফুট আয়োজন করেন। কী বলছি সেটা হয়তো আরেকটু স্পষ্ট বোঝা যাবে দুর্গেশনন্দিনী-র প্রথম খণ্ডের ‘আশমানির অভিসার’-শীর্ষক দ্বাদশ পরিচ্ছেদের দিকে তাকালে। বয়ানটা এইরকম:

দিগ্‌গজ গজপতির মনোমোহিনী আশমানি কিরূপ রূপবতী, জানিতে পাঠক মহাশয়ের কৌতূহল জন্মিয়াছে সন্দেহ নাই। অতএব তাঁহার সাধ পূরাইব। কিন্তু স্ত্রীলোকের রূপবর্ণন-বিষয়ে গ্রন্থকারগণ যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া থাকেন, আমার সদৃশ অকিঞ্চন জনের তৎপদ্ধতি-বহির্ভূত হওয়া অতি ধৃষ্টতার বিষয়। অতএব প্রথমে মঙ্গলাচরণ করা কর্তব্য।
হে বাগ্‌দেবি! হে কমলাসনে! শরদিন্দুনিভাননে! অমলকমল-দলনিন্দিত-চরণ-ভক্তজন-বৎসলে! আমাকে সেই চরণকমলের ছায়া দান কর; আমি আশমানির রূপ বর্ণন করিব। হে অরবিন্দানন-সুন্দরীকুল-গর্ব-খর্বকারিণি! হে বিশাল রসাল দীর্ঘ-সমাস-পটল-সৃষ্টিকারিণি! একবার পদনখের এক পার্শ্বে স্থান দাও, আমি রূপ বর্ণন করিব। সমাস-পটল, সন্ধি-বেগুন, উপমা-কাঁচকলার চড়চড়ি রাঁধিয়া এই খিচুড়ি তোমায় ভোগ দিব। হে পণ্ডিতকুলেপ্সিত-পয়ঃপ্রস্রবিণি! হে মূর্খজনপ্রতি ক্বচিৎ কৃপাকারিণি! হে অঙ্গুলি-কণ্ডূয়ন-বিষমবিকার-সমুৎপাদিনি! হে বটতলা-বিদ্যাপ্রদীপ-তৈলপ্রদায়িনি! আমার বুদ্ধির প্রদীপ একবার উজ্জ্বল করিয়া দিয়া যাও। মা! তোমার দুই রূপ; যে রূপে তুমি কালিদাসকে বরপ্রদা হইয়াছিলে, যে প্রকৃতির প্রভাবে রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, শকুন্তলা জন্মিয়াছিল, যে প্রকৃতির ধ্যান করিয়া বাল্মীকি রামায়ণ, ভবভূতি উত্তরচরিত,  ভারবি কিরাতার্জুনীয় রচনা করিয়াছিলেন, সে রূপে আমার স্কন্ধে আরোহণ করিয়া পীড়া জন্মাইও না; যে মূর্তি ভাবিয়া শ্রীহর্ষ নৈষধ লিখিয়াছিলেন, যে প্রকৃতিপ্রসাদে ভারতচন্দ্র বিদ্যার অপূর্ব রূপবর্ণন করিয়া বঙ্গদেশের মনোমোহন করিয়াছেন, যাহার প্রসাদে দারথি রায়ের জন্ম, যে মূর্তিতে আজও বটতলা আলো করিতেছ, সেই মূর্তিতে একবার আমার স্কন্ধে আবির্ভূত হও, আমি আশমানির রূপ বর্ণন করি।
   আশমানির বেণীর শোভা ফণিনীর ন্যায়; ফণিনী সেই তাপে মনে ভাবিল, যদি বেণীর কাছে পরাস্ত হইলাম, তবে আর এ দেহ লোকের কাছে লইয়া বেড়াইবার প্রয়োজনটা কি! আমি গর্তে যাই। এই ভাবিয়া সাপ গর্তের ভিতর গেলেন। ব্রহ্মা দেখিলেন প্রমাদ; সাপ গর্তে গেলেন, মানুষ দংশন করে কে? এই ভাবিয়া তিনি সাপকে ল্যাজ ধরিয়া টানিয়া বাহির করিলেন, সাপ বাহিরে আসিয়া, আবার মুখ দেখাইতে হইল, এই ক্ষোভে মাথা কুটিতে লাগিল, মাথা কুটিতে কুটিতে মাথা চেপ্টা হইয়া গেল, সেই অবধি সাপের ফণা হইয়াছে। আশমানির মুখ  চন্দ্র অধিক সুন্দর, সুতরাং চন্দ্রদেব উদিত হইতে না পারিয়া ব্রহ্মার নিকট নালিশ করিলেন। ব্রহ্মা কহিলেন, ভয় নাই, তুমি গিয়া উদিত হও, আজি হইতে স্ত্রীলোকদিগের মুখ আবৃত হইবে; সেই অবধি ঘোমটার সৃষ্টি। নয়ন দুটি যেন খঞ্জন, পাছে পাখি ডানা বাহির করিয়া উড়িয়া পলায়, এই জন্য বিধাতা পল্লবরূপ পিঁজরার কবাট করিয়া দিয়াছেন। নাসিকা গরুড়ের নাসার ন্যায় মহাবিশাল; দেখিয়া গরুড় আশঙ্কায় বৃক্ষারোহণ করিল, সেই অবধি পক্ষিকুল বৃক্ষের উপরেই থাকে। কারণান্তরে দাড়িম্ব বঙ্গদেশ ছাড়িয়া পাটনা অঞ্চলে পলাইয়া রহিলেন; আর হস্তী কুম্ভ লইয়া ব্রহ্মদেশে পলাইলেন; বাকি ছিলেন ধবলগিরি, তিনি দেখিলেন যে, আমার চূড়া কতই বা উচ্চ, আড়াই ক্রোশ বই ত নয়, এ চূড়া অন্যূন তিন ক্রোশ হইবেক; এই ভাবিতে ভাবিতে ধবলগিরির মাথা গরম হইয়া উঠিল, বরফ ঢালিতে লাগিলেন, তিনি সেই অবধি মাথায় বরফ দিয়া বসিয়া আছেন।
আমরা যারা আজকের দিনের ভাষ্যকার, এরকম বয়ান দেখলেই তাদের হাত নিশপিশ করে। “যাই, বটতলার সঙ্গে তথাকথিত সৎসাহিত্যের দ্বৈরথের কথা উত্থাপন করে সাংস্কৃতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের সরঞ্জাম ধরে আনি, আলোচনাটা জমবে ভালো,” বলে উঠি আমরা কালবিলম্ব না করে। বঙ্কিম কিন্তু গুরু সংস্কৃতি আর লঘু সংস্কৃতির মেরুবিভাজন নিয়ে খেলাও করছেন, সেই খেলার মাধ্যমে অন্য কাজও গোছাচ্ছেন। গুরু-লঘুর ওই মেরুবিভাজনে ক্ষমতার লড়াই নিহিত আছে কি নেই সেটা ওঁর দিগন্তে সমস্যা রূপে দেখা দেয়নি।
   আস্ত পরিচ্ছেদটাকে গন্ধমাদনের মতো ধরে আনলাম যাতে সবাই পরিষ্কার দেখতে পান যে, স্ত্রীচরিত্রচিত্রণের প্রকল্পটা বঙ্কিমের রণকৌশলে এতই জরুরি যে এমনকি বহিরঙ্গ বর্ণনার জায়গাটাতেও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের পারস্পরিক বিক্রিয়া কীভাবে পাঠকের চৈতন্য জুড়ে থাকে সে দিকেও বলে-কয়ে নজর টানছেন।
   অতঃ কিম্? যদি ধরে নিই আপনি মেনে নিয়েছেন আমার কথাগুলো একেবারে অমূলক নয়, অন্তত তার কিছু শিকড়-বাকড় বঙ্কিমের বয়ানেও পাওয়া যায়, তাহলে এর পর আমার যুক্তি কোন দিকে নিয়ে যেতে চাইছি?

0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]

<< Home