Sunday, December 16, 2012

Goddo o Bonkimcandro: Ubhoshanketoner prostaabona: TRITIYO KISTI


।।কেন্দ্র থেকে দূরে বসে নিরিবিলি কথা বলা।।

ভাষাতত্ত্বের পাঠ্যবইয়ে পাবেন একরকম বক্তব্যতত্ত্বের মূলসূত্র। আদর্শ উপস্থাপনের ওই সূত্রগুলো (গ্রাইস ১৯৭৫) দেখতে সোজা: পরিশীলন (সত্যি বলছ কিনা), পরিমিতি (বেশি বা কম বলছ কিনা), রীতি (যেভাবে বললে শ্রোতার সুবিধে তা থেকে ভীষণ অন্য কায়দায় বলছ কিনা), প্রাসঙ্গিকতা। ভাষাতত্ত্বের বইয়ের অনেক লেখক ধরে নেন মুখের কথার দিকে কিংবা লিখিত বয়ানের দিকে কোনো পক্ষপাত নেই উপস্থাপনের ওই-চারটে সূত্রে, ধরে নেন ওগুলো ভাষার মৌখিক বা লিখিত যেকোনো প্রয়োগমাধ্যমের বেলাতেই নিরপেক্ষভাবে খাটে। কিন্তু গ্রাইস তো কথোপকথনের মূলসূত্রই লিখতে চেয়েছিলেন। নাহয় তাঁর কথাটাই রাখলাম। তাহলে দাঁড়াচ্ছে, ক্ষমতা-বিদ্ধ লিখিত ভাষা থেকে একটু দূরে বসে নিভৃতে কথা হচ্ছে কোনো বক্তা আর কোনো শ্রোতার মধ্যে, কারণ দেখা গেছে চোখধাঁধানো আলোর প্রকাশ্য পরিসর থেকে ওটুকু দূরত্ব না থাকলে সেই ন্যূনতম আরাম থাকে না যে-আরাম কথা বলতে পারার, বুঝতে পারার, পূর্বশর্ত।
   প্রশ্নটা হল, এই ন্যূনতম দূরত্বের ব্যাপারটা কী? কস্মিন কালেও তো এর কথা তোলেননি কোনো ভাষ্যকার? একটু খুলে বলি; এই উপস্থাপনের উৎস দুর্গেশনন্দিনীর বয়ানেই।
কোনো একটা প্রতিষ্ঠানের অথবা সামাজিক আয়োজনের বিলি-বাটোয়ারার বন্দোবস্তই বলুন, ব্যবস্থাই বলুন, সবই এমন জিনিস যে সেসব কথা যদি কোনো দলিলে সুস্পষ্ট করে গুছিয়ে দেওয়া থাকে তাহলে সে-দলিল ওইসমস্ত খুঁটিনাটি দস্তুরমতো খুলে বলে। সে-কাজ করতে গিয়ে দলিল একই কথা বারবার বলতে বাধ্য হয়, কারণ পুনরুক্তি না করলে দ্ব্যর্থহীন স্পষ্টতা পাওয়া যায় না। আইনকানুনের দলিল দেখলে যে সাধারণ পাঠক বিমূঢ় বোধ করে, সুযোগ পেলেই পালিয়ে যায়, তার একটা কারণ তো এই ক্লান্তিহীন পুনরুক্তি।
কথাবার্তা এর ঠিক উলটো। একজন মানুষ যখন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলে, তখন প্রতিষ্ঠানের সীমা-সরহদ্দ বেঁধে দেওয়া দলিল থেকে তার কথার ধরন একেবারে আলাদা না হলে সে নিজের অদ্বিতীয় পুনরুক্তিবিহীন ব্যক্তিগত বিশিষ্টতা প্রকাশ করবে কী করে? তাই প্রতিষ্ঠানের ভঙ্গির একেবারে উলটো দিকে হাঁটতে হয় তাকে। গ্রাইস যে আদর্শ কথোপকথনের রীতি শনাক্ত করতে চেয়েছিলেন, তাঁর সেই মূলনীতিগুলোর তাহলে দুই পর্যায়ের প্রযোজ্যতা ধরে নিতে হবে। কোনো ব্যক্তি যখন কথা বলছে তখন প্রথম দফার প্রযোজ্যতা। দ্বিতীয় দফার দরকার হয় কোথায়? সেইসব দলিলে যেখানে মৌখিক ভাষার সাধ আর সাধ্যের উপর আরেকটু চাপ দিয়ে মানুষ প্রতিষ্ঠানের হয়ে কথা বলে দেখে এই খেলা খেলতে নেমেও ভাষার পক্ষে ভাষাত্ব বজায় রাখা সম্ভব থাকছে কিনা। অর্থাৎ গ্রাইসের মূলসূত্রের দু রকম প্রয়োগের মধ্যে যে ব্যবধান সেখানেই লিপির সঙ্গে মৌখিকতার দূরত্ব রচিত হয়। সেই দূরত্ব যখন লোপ পায় তখন আবির্ভূত হয় মূর্তিমান প্রতিষ্ঠানের দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ অস্বাভাবিক ব্যক্তি, যার কথা শুনতে একেবারে কারটুনের মতো: “নমস্কার, আমি অমুকনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র তমুকচন্দ্র, তোমার হাতের অ্যাডমিট কার্ড দেখে অনুমান করলাম তুমিও তাই, আমাকে বলা হয়েছে আমার সমগোত্রীয়দের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে, সুতরাং তোমাকে সম্বোধন করলাম, তুমি কি আমার কথার উত্তর দেবে?”
এই রকম মূর্তিমান কারটুনের কথাবার্তা শুনলে বোঝা যায়, লিখিত ভাষা যখন মৌখিকের ছদ্মবেশ ধারণ করেও নিজের আক্ষরিকতা বজায় রাখে, তখন কীভাবে কথাবার্তার দফা রফা হয়ে যায়। মৌখিকের সঙ্গে লিখিতের স্বাভাবিক দূরত্বটাকে এভাবে তাড়িয়ে দিলে তার যে অদ্ভুত ফল হয় সেটা দেখে বুঝতে পারি দূরত্বটা কী কাজ করে।
ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে একটু দূরে গিয়ে বসলে তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের নিভৃত কথাবার্তা জমে, এই ইঙ্গিত করেছিলেন স্বয়ং বঙ্কিম, দুর্গেশনন্দিনীর বয়ানেই। দ্বিতীয় খণ্ডের একাদশ পরিচ্ছেদে ওসমানকে দিয়ে বলাচ্ছেন, “আপনি তো রাজনীতিজ্ঞ বটেন, ভাবিয়া দেখুন, দিল্লী হইতে উৎকল কত দূর।” অর্থাৎ ‘ওরা’ যে-রাজধানীতে বসে শাসন করছে সেখান থেকে দূরে বাস করি প্রাদেশিক ‘আমরা’ যারা সাধ্যমতো ‘যা খুশি তাই করি’।
ক্ষমতা থেকে দূরত্ব রচনার একটা ধরন নিয়ে ভাবতে গিয়ে সবাই মিলে সঙ সাজার যে-মজা তার ভাষ্য লিখেছিলেন বাখতিন (১৯৯৩); তাঁর ভাবনা আজকালকার উপন্যাসতত্ত্বের ভিত্তি। কিন্তু বক্তব্যতাত্ত্বিক সরঞ্জামের খুঁটিনাটিতে কী রদবদল করলে বিষয়টাতে আলোকপাত করা সহজ হবে সেটাই আমার আশু জিজ্ঞাস্য; সেইজন্যে এখানে বাখতিনে যাচ্ছি না।
আমি ধরে নেব, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সংলাপের যে সামগ্রিক সুবিবেচনা গ্রাইসের মূলসূত্রে ফুটে ওঠে, তার সঙ্গে সামাজিক বিজ্ঞানে আর গণিতে আকরণে যে নৈর্ব্যক্তিক যুক্তিনিষ্ঠার প্রতিমা গড়া হয় সেইটার প্রতিমানের স্পষ্ট প্রভেদ রয়েছে। গ্রাইসীয় আদল যে আদর্শ বক্তার ছবি আঁকে সে মূলসূত্রগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে ঠিকই, কিন্তু সে এই অর্থে আদর্শ নয় যে তার মুখ থেকে অসম্ভব লম্বা লম্বা বাক্য বেরোতেই পারে বলে ধরে নিতে বলছেন গ্রাইস; চমস্কির আদর্শায়ন আর গ্রাইসের আদর্শায়ন গুলিয়ে ফেলা ভুল। বক্তব্যতত্ত্বের ভাষ্য রচনা করতে সুবিধে হবে বলে আমরা এমন আদর্শ বক্তার ছবিই আঁকতে চাইব যে গ্রাইসীয় মূলসূত্রগুলো সদা সর্বদা পালন করে। কিন্তু সেই ছবিতে যদি অবাধ দৈর্ঘ্যের বাক্যের পর বাক্য অনর্গল বলে যাওয়ার ক্ষমতা জুড়ে দিই তাহলে কল্পনার গোটা খেলাটাই যাবে ভেস্তে। অন্য লোকের দিকে অতিদীর্ঘ আর অতিজটিল বাক্য ছুঁড়ে মারতে যে লোক রাজি, সে তো সংবেদের বা পারস্পরিকতার কোনো ধার ধারে না দেখাই যাচ্ছে।
আমি সুবিবেচনার আদর্শচিত্রের সঙ্গে যুক্তিনিষ্ঠার আদর্শচিত্রের এই যে তফাত ধরে নিয়ে এগোচ্ছি সেই সীমারেখাটা ঠিক কোথায়? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিলে আমার সমালোচক ভেবে বসতে পারেন আমি ভাবছি গ্রাইসের কল্পিত আদর্শ বক্তা এতই কম কথার মানুষ যে সে মানবেতর প্রাণীর মতোই ভাজা বাক্যটি উলটে খেতে জানে না – অর্থাৎ বাক্যের বেষ্টনে অন্য বাক্য রেখে “রাম জানে যে শ্যাম আসবে” বলতে পারে না, যে অক্ষমতা দেখা গেছে শিম্পাঞ্জিদের বেলায়। আমি কি ধরে নিতে বলছি যে, স্বাভাবিক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মনোযোগ যেটুকু দম রাখতে পারে বলে জানা গেছে, সেই সীমার মধ্যেই যতটা যা বাক্যবেষ্টিত বাক্যের উপদ্রব সহ্য করা যায়, গ্রাইসীয় আদর্শচিত্রের দৌড় সেই অবদি?
কল্পিত সমালোচকের এই কথার আমি যে উত্তর দেব সেটা যুগপৎ আকরণিক বিজ্ঞানের এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিবেচ্যসূচির চোখে চোখ রেখে চলে। আমার অবস্থান এইরকম। ক্ষমতা-তথা-জ্ঞানের শাসনতন্ত্রের কেন্দ্র থেকে যে স্বভাবসিদ্ধ লিখিত বাচকতা নিঃসৃত হতেই থাকে – যার মৌখিক সংস্করণও থাকে বটে কিন্তু লিখিতের মুখাপেক্ষী – সেই বাচকতার জায়গাটাতে চমস্কীয় আদর্শায়ন বসানো সংগত। অর্থাৎ এইটা কল্পনা করার মানে হয় যে, কোনো একজন শাসকের হয়ে মানুষ হোক, কমপিউটার হোক, শাসকের আদর্শ আজ্ঞাবহ কোনো বক্তা এতই বাচাল, তার বাক্য এতই যথেচ্ছ দীর্ঘ আর কণ্টকিত, যে সঞ্জননী ব্যাকরণ যে-অবাধ লীলাক্ষেত্র পেলে নিজের পুরো খেলা দেখাতে পারে সেই জমির সবটাকেই দখল করে তার আদর্শ অসীম মনোযোগের দাবি। পক্ষান্তরে যে মৌখিক ভাষা স্বাভাবিক মানুষের মুখে আসে তার বৈশিষ্ট্য হল পরস্পরমুখাপেক্ষী অসীমতা। একজন বক্তা কখনও ভিনবক্তার, কখনও নিজেরই, পূর্ববাক্য থেকে খেই ধরে সংলাপের মাধ্যমেই গল্প ফেঁদে খেলা করে দেখিয়ে দেয় কেন্দ্রের কর্তৃত্বের যে বাগ্মিতা-বিদ্ধ রীতি তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কথাবার্তা শুধু যে পেরে ওঠে তাই নয়, সুবিবেচনা-প্রসূত জটিল আখ্যানশিল্পে তাকে হার মানিয়ে ছাড়ে। এ কথা বলে আমি আগাম বাজি ধরছি না যে শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁরা কখনোই মানুষের কাছে প্রশিক্ষণ পাওয়া বিশেষ শিম্পাঞ্জিদের উক্তিতে সর্বনাম দেখাতে পারবেন না। সে-আবিষ্কারের পর এও হয়তো দেখা যাবে যে শিম্পাঞ্জিরা পরস্পরের বাক্যের পিঠে বাক্য জুড়ে এমনকি আড্ডা মারতেও পারে; সেই সম্ভাবনাটাকেও আগে থেকে উড়িয়ে দেওয়া আমার উদ্দেশ্যের মধ্যে পড়ে না। আমি খেয়াল করতে বলব যে বাচকীয় তন্ত্রের সঙ্গে সুবিবেচনার ভিত্তিতে সামগ্রিক মোকাবিলা করতে বা চ্যালেঞ্জ করতে শিম্পাঞ্জিরা যে চির-অপারগ এটা গত কয়েক দশকের গবেষণাতেই পরিষ্কার বোঝা গেছে, এ সিদ্ধান্ত পালটাবার নয়।
বাখতিনের বিবেচিত রাবলে-চিত্রিত সামূহিক বিদূষকতার জায়গাটা তাহলে ক্ষমতার বিরুদ্ধে জনগণের কণ্ঠে ধ্বনিত চিরপ্রতিবাদের বিশেষ দৃষ্টান্তের মতো দেখায়, আমার প্রস্তাবিত ভাষ্যের দিক থেকে দেখলে। কথাবার্তা ব্যাপারটাই গণতন্ত্রের পীঠস্থান হিসেবে গণনীয়; আদর্শ বৈঠকখানায় বসে আদর্শ আড্ডাবাজেরা কেন্দ্রের বাচকতাকে ভাসিয়ে দেয় সবাক হাসির তুফানে।
যে দাবিটা বিশেষ আকরণিক মনোযোগের অপেক্ষা রাখে তা হল এই: কথাবার্তা শিলীভূত নয়, প্রবহমাণ। একজন যা বলল সেটা তার পরবর্তী বক্তার খেই ধরায় পৌঁছে পালটে যায়। কেন্দ্র থেকে যে বাচকতা নির্গত হচ্ছে তার নিরেট নিরেট উদ্ভাবনগুলো আড্ডাবাজদের লোফালুফিতে টুকরো টুকরো হয়ে যায়; তখন সাধারণ লোকের পক্ষেও সেগুলোকে যাচাই এবং প্রয়োজন হলে খণ্ডন করা সম্ভব; এইভাবে ক্ষমতাশালীদের একেকটা প্রতারণা ধরা পড়ে।
এই বিবেচনার ভিত্তিতে আমার প্রস্তাব, গণতান্ত্রিক কথোপকথনের সংস্কৃতিতে দ্বিসংকেতনের বর্ণালীর দুর্গম বা উচ্চ মেরু আর সুগম অথবা নিম্ন মেরুর মধ্যেকার পারস্পরিক সমালোচনার সম্বন্ধটাকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে ধরে নেওয়া যাক,   উ ভ সং কে ত ন   সেই পারস্পরিকতার প্রক্রিয়া যার শক্তিতে দুর্গমের রাজধানীতে বসেও সুগমের নাগাল পাওয়া যায় এবং সুগমের বৈঠকখানায় বসে দুর্গমকে খণ্ডন করা যায়। এই শক্তির কী সাধ্য, কী অসাধ্য, সে প্রশ্নের কোনো চূড়ান্ত জবাব এই মুহূর্তে কেউ দিতে পারবে না। সাহিত্যসমালোচকদের বৃত্ত থেকে কেউ কেউ এই জিজ্ঞাসারীতিতে যোগ দিয়ে কথাটাকে এগিয়ে নিয়ে গেলে নিশ্চয়ই সকলেরই লাভ। তবে খেয়াল করা ভালো, উভসংকেতনের প্রক্রিয়াটা গণতন্ত্রেরই খাস তালুক। ভাবী কালের মানুষকে সারস্বত কর্মীদের বাহাদুরি এ বিষয়ে আমাদের চেয়ে বেশি স্পষ্টতায় পৌঁছোতে তেমন কিছু চমকপ্রদ সাহায্য না করতেও পারে। নিত্যনতুন সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যোগ দিয়ে গণতন্ত্রের নাগরিকদের যা অভিজ্ঞতা হবে তাতেই তাঁরা উভসংকেতনের স্বরূপ পরিষ্কার দেখতে পাবেন বলে আমার ধারণা। তবে এই যোগদানের সবটা যে ঝাণ্ডার নিচে দাঁড়িয়ে হয় না, গল্পের বই পড়তে পড়তেও যে আমাদের পঠনরীতি আমাদের গণতান্ত্রিকতার সূত্র রচনা করে চলে, এ ব্যাপারে সচেতনতার শিক্ষাগুরুদের মধ্যে অন্যতম বঙ্কিমচন্দ্র নিজে।

0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]

<< Home