Monday, March 18, 2013

Jabaan-jominer aabaad


[‘ভাষা, সাহিত্য ও সমাজ: পরিবর্তন, সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় চর্চাসত্রের প্রস্তাবনা-ভাষণ, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, শিলচর, ১২-১৩.৩.২০১৩]

সারসংক্ষেপ

বেশ কিছু ভাষার বিপন্নতা নিয়ে মনীষীরা সম্যক উদ্‌বিগ্ন। সেইসব ভাষার জমিতে আবাদ করলে সোনা ফলবে বলে তাঁদের বিশ্বাস। এধরনের বিশ্বাসে অথবা উদ্‌বেগে সায় দেবার আগে একটু ভেবে দেখা দরকার। যে-মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে এইসব ভাষার আসন্ন পতনের ভয়ে তাঁরা ভীত, সেটার অঙ্কনভঙ্গিতে ধরেই নেওয়া আছে যে সর্বাধিক সফল ভাষা ইংরিজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজলি সড়ক পানি ভিত্তিক আধুনিকমন্য উন্নয়নের ধাঁচটাই বুঝি সর্বজনস্বীকার্য। মানচিত্রপ্রণেতারা ধরেই নিতে বলেন যে অন্যান্য ভাষার বেলাতেও সাফল্যের জ্যামিতি একইরকম দেখাবে। কিন্তু সমৃদ্ধির বিকল্প পথের সন্ধান পেলে, জল জঙ্গল জমিনের দিকে মন দিতে শিখলে, বিপদের আসল উৎস যে ধরতাই বুলিতে গা ভাসিয়ে দেওয়া তথাকথিত মূলস্রোত, তার চোখে চোখ রেখে আমরা সত্যিই বর্তমান সংকটের কল্পনা পার হয়ে এগিয়ে যেতে পারব। যে দ্বিসংকেতনে ইংরিজির সিংহাসন নির্মিত, তারই পাদপ্রদীপের জায়গাটাকে উজ্জ্বলতার প্রকৃত অকুস্থল বলে চিনতে শিখব। পুনর্বিবেচনাপ্রসূত নতুন দৃষ্টি অর্জন করে সমস্যার এবং সমাধানের জায়গা খুঁজে নিতে পারব যুক্তিগ্রাহ্য মানচিত্রে।


।।উ প ক্র ম ণি কা।।

    অনেকের জানা গানের কলি থেকেই শুরু করি: ‘মন রে, কৃষিকাজ জানো না/ এমন মানব-জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা’। কেউ কেউ মনে করেন, ভাষার শ্রীবৃদ্ধি নির্ভর করে ভাষা-পরিকল্পনা বলে একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার উপর। সে-কাজের অন্যতম উপাদান হিসেবে তাঁরা তুলে ধরেন ‘ভাষা-পরিশীলন’ বলে একটা উপপ্রক্রিয়াকে। এর ইংরিজি নাম রেখেছেন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ কালটিভেশন’। শুনে খালি-যে চাষবাসের কথাই মনে পড়ে তাই নয়। আবাদ যেখানে হবে সে-জায়গাটাকে জমি বলে ভাববার ঝোঁককেও প্রশ্রয় দেওয়া হয় এই বাচনভঙ্গিতে। জমিটা তখন লড়াইয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সে-লড়াইয়ের অস্ত্র নতুন নতুন পরিভাষা সৃষ্টি, সেইসব শব্দ চালু করবার জন্যে বিশারদদের দিয়ে বইপত্র লেখানো – এবং আজকের দিনে সচিত্র এবং/অথবা সবাক বৈদ্যুতিন দলিল প্রণয়ন করানো – তারপর জনগণের মনের সরোবরে সেইসমস্ত মাছ ছেড়ে দেওয়া যাতে তারা ডিম পাড়ে। এভাবে নাকি শত্রুকে কাত করা যাবে। সেই শত্রু নাকি বৃহত্তর ভাষার, যেমন ইংরিজি বা হিন্দি বা অসমিয়া বা বাংলার, শব্দের অনুপ্রবেশ। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া আর সেই বেড়ার সশস্ত্র পাহারাওয়ালা রাখলেই বুঁদির কেল্লা সুরক্ষিত থাকবে সারাক্ষণ। কেউ কেউ এইরকম একটা গল্প বলে চলেছেন অনেক দিন ধরে। এবং গল্পটা লোকে যাতে বিশ্বাস করে সেজন্যে যথাসাধ্য গেল গেল ধর্ ধর্ রব তুলে লোকজনের মনে উদ্‌বেগ বাড়িয়ে তুলেছেন।
    বিপদ আছে সেকথা সত্যি। কিন্তু ত্রস্ত হলে সে-বিপদ ঠেকানো যাবে না। বিপন্ন ভাষা নিয়ে আলোচনার সূত্রে কাণ্ডারিরা চেষ্টা করেন ছোটো ছোটো ভাষার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে। তারপর কায়দা করে আলোচনার ধারা নিয়ে আসেন এমন নীতির দিকে যাতে লোকে সায় দিয়ে কাণ্ডারিদের হাতে যেসব অস্ত্রশস্ত্র আছে সেগুলো প্রয়োগ করার পক্ষে ভোট দিয়ে ফেলেন। আমার প্রধান বক্তব্য এই: ওই কাণ্ডারিদের মতলব লক্ষ করে যদি আপনারা তাঁদের অভিসন্ধি ভণ্ডুল করতে একটুও চান, তাহলে আপনাদের অন্যতম কর্তব্য হল ওঁরা যেদিকে নজর দিতে বারণ করছেন সেদিকেও তাকানো। অর্থাৎ, তথাকথিত সফল ভাষাগুলোর ওই বহু বিজ্ঞাপিত সাফল্যের দিকেও নজর দেওয়া। যেমন ইংরিজি। শুধু ইংরিজি কেন? মানছি, অন্যদের দাপটের দিকেও তাকানো নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু এক নিঃশ্বাসে ইংরিজি হিন্দি বাংলা অসমিয়ার কথা বলতে গেলে সমস্ত তালগোল পাকিয়েও যাবে, আমার মতো কোনো একজন কর্মীর বিদ্যেতেও কুলোবে না। বিশেষ বিশেষ দাপটের ভুক্তভোগীরা আজ না হোক কাল সেই সেই গল্প তুলে ধরবেন বলে ভরসা রাখি।
    দক্ষিণ এশিয়ায় যেভাবে ব্রিটিশ শাসনের দরুন ইংরিজি এসেছিল, সেভাবেই নানাবিধ ঔপনিবেশিক শাসকের হাত ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে ডাচ, ফরাসি, পোর্তুগিজ, স্প্যানিশ, এমনকি ইটালিয়ান এসেছিল। সেসব ভাষার দায়ভাগের সঙ্গে মোকাবিলা করার কাজ আজও শেষ হয়নি এশিয়ায়, আফ্রিকায়, আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়। অধিকন্তু আদিবাসীদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে আমরা যারা অনাদিবাসী তাদের চাপিয়ে দেওয়া ভাষাগুলোর উদ্‌বৃত্ত দাপটের মানচিত্র আঁকা; এবং সহজবোধ্য বিরূপতা সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গে বসেই ঠিক করা, কীভাবে আমাদের দীর্ঘকালীন অত্যাচারের কুফল কাটিয়ে উঠে তাঁরা এমনভাবে দেশের সমস্ত নাগরিকের সঙ্গে ঘর করতে পারবেন যাতে একদিকে তাঁদের আদিবাসী মাতৃভাষাসমূহের শ্রীবৃদ্ধিও হয়, আবার অন্যদিকে এই প্রক্রিয়ার ফলে কোনো এলাকা-বিশেষে সীমাবদ্ধ ভাষার শিক্ষাদীক্ষায় আটকে গিয়ে তাঁরা দেশের সর্বত্র অবাধে ঘুরবার ফিরবার কিংবা বাসা বাঁধবার অধিকার হারিয়েও না ফেলেন।
    চোখে আঙুল দিয়ে ফরাসি পোর্তুগিজের কথা বলবার দরকার হত না যদি ভারতে সকলেরই জানা থাকত যে আফ্রিকায় ফরাসিদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে সকলেই আজও লেখাপড়া থেকে শুরু করে প্রশাসনাদি সবই ফরাসিতে করে থাকে। আফ্রিকানদের নিজস্ব প্রস্তাবের দৌলতে ছোটো ছোটো খেলনা সিংহাসনে যেসব সোয়াহিলি-টোয়াহিলিকে বসানো হয়েছিল সেসমস্ত বিস্তৃত-অথচ-আঞ্চলিক ভাষা যাতে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকে তার জন্যে সমাজের অনেক মহল উঠে পড়ে লেগেছিল। তারা যা চেয়েছিল আপাতত সেটা পেয়েও গেছে, চিন্তাশীলদের আলস্যের ফলে। তাই ব্যাপক লড়াইটা স্রেফ ইংরিজির সঙ্গে পেরে ওঠার ব্যাপার নয়; সমস্ত প্রাক্তন ঔপনিবেশিক ভাষার দাপটের সযত্ন ইতিহাসমনস্ক মানচিত্র আঁকতে আঁকতে এগোতে হবে আমাদের। জমির লড়াইয়ের শস্তা জনবাদী স্লোগানে নিজেদের আটকে যেতে দেওয়া-যে আসলে রণে ভঙ্গ দেওয়ারই নামান্তর, এই সত্যটা আমরা অনেকে দেখতে পাচ্ছি না বলেই আমাদের এতটা শক্তিক্ষয় আর সময় নষ্ট হচ্ছে।
    জবান-জমিন রইল পতিত? আবাদ করলে ফলত সোনা? এই সুরে যে-লোক গান ধরতে রাজি সে কি বুঝতে পেরেছে কোনটা সোনা, কোনটা রুপো, কোনটা তামা? সদাগরপুত্রকে রাজপুত্র ভেবে সিংহাসনে বসিয়ে দেয়নি তো?
    উন্নয়নের সামগ্রিক ধারণার হাত ধরেই ভাষা-পরিকল্পনার ভাষ্য উঠে এসেছে। বিজলি-সড়ক-পানি যে-আদলের মন্ত্র, তার বিকল্প হিসেবে আজকাল কোনো কোনো মহলে অবশেষে জল-জঙ্গল-জমিনের নতুন আহ্বান খানিকটা গ্রাহ্যতা পেতে শুরু করেছে। আমি-যে সেই বিকল্পের হয়েই ভাষ্য নির্মাণ করার চেষ্টা করছি সেকথা খোলাখুলি জানিয়ে কাজ শুরু করছি এখানে। কাজটা চট করে হবে না। সেজন্যে লক্ষ্যসচেতনতা অর্জন করার দিকে মন দেওয়া দরকার গোড়াতেই। এক কথায় বলতে পারি, আমার লক্ষ্য হল বড়োলোক ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয়ধন্য বিজলি সড়ক পানিতে যে-সড়কের জয়গান রয়েছে তার পাশ দিয়ে মানুষের পথ চলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ধীরগতি সমঝদার লড়াইটাকে ভারতীয় গণতন্ত্রে এমন স্থায়ী কাজের জায়গা হিসেবে বসানো যে বণিকেরা আমাদের সঙ্গে লাগতে আসবার আগে সাত বার ভাববে। এ-কাজ শুরু করতে পারার প্রথম ধাপ হল, পোশাকি কথাবার্তার যে-জায়গাটা ওরা চুপিচুপি কবজা করে নিয়েছে সেইটাকে আবার দখল করা। তাই কিছু কিছু লেখাপড়ার প্রসঙ্গের অবতারণা – যে-লেখাপড়ার এলাকাটা ব্যবসায়ীর দল আর তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা, খোলাখুলিই বলছি, ছেঁদো বইয়ের পর ছেঁদো বই লিখে ভাসিয়ে দিয়েছে।
    যাঁরা না বুঝে ব্যবসায়ীদের অর্ধসত্যগুলোতে সায় দিয়ে ফেলেছেন তাঁরা অনেকে ভেবে মরেন, যেসব ভাষা অপাঙক্তেয় হয়ে রইল কিংবা সাবেক কালের পাঙক্তেয়তা হারাতে বসেছে, তাদের কী হবে। ওভাবে ক্ষয়ের আর ব্যর্থতার কথা ভেবে যাঁরা বিলাপ করছেন অথবা প্রতিকার চাইছেন তাঁরা অনেকেই ধরে নিয়েছেন, পরম সার্থক ভাষা হিসেবে ইংরিজির উত্থানের কষ্টিপাথরে বিচার করাই এযুগের সকল বিশ্লেষণকারীর কর্তব্য। এই ধরে নেওয়াটাকে বিচার করতে চাইলে ইংরিজির ওই ঘোষিত সাফল্যের দিকে মন দিয়ে তাকানো জরুরি। অনেকেই সে-কাজ করে ওঠার সময় পাননি। এ-বিষয়ে আমি কিছু দিন ধরে যা নাড়াচাড়া করছি তার কিছু ফসল নিবেদন করতে চাইছি তাঁদের কাছে যাঁরা ‘আবাদ আবাদ’ বলে এইরকম জমিবাজি করতে ব্যস্ত। তারপর তাঁদের সঙ্গে বসে ভাবতে হবে। মানব-জমিন কাকে বলে? আবাদ কাকে বলে? ভিটেমাটির প্রশ্ন সেখানে লোকের তাৎক্ষণিক আবেগের জায়গাটাতে যেভাবে জড়িয়ে গেছে সেই উপস্থাপনটাতে সায় দেওয়া কি চিন্তাশীল কর্মীর পক্ষে ঠিক কাজ? পুনর্বিবেচনা করলে মানচিত্র কীরকম পালটে যায়? তখন কর্তব্য আর অকর্তব্য কেমন দেখায়? ইত্যাদি। সবটাই-যে এক পশলা আলোচনায় মীমাংসিত হবার নয় সে-কথা নিশ্চয় বলাই বাহুল্য। আশা করব আমার এই বক্তব্য খণ্ডন করার জন্যে বিপক্ষের কর্মীরা এগিয়ে আসবেন। যে-পাঠকেরা নিরপেক্ষ, তাঁরা আশা করি নজর রাখবেন বিপক্ষ এবার আমার বক্তব্যের জবাব দিচ্ছে, না যথারীতি পালিয়ে বেড়াচ্ছে।


ভারতে ইংরিজির বিখ্যাত জয়যাত্রা

ভারতে ইংরিজির সত্যিসত্যিই কীরকম অবস্থিতি, এ-প্রশ্নের ভাষাতাত্ত্বিক সরঞ্জাম বিদ্ধ জবাব দিতে বসলেই দ্বিসংকেতনের প্রসঙ্গ তুলতে হয়। প্রথমে তাই সংকেতন আর দ্বিসংকেতনের কিছু বুনিয়াদি সূত্র পেশ করলে পারি। মোটা দাগের সংজ্ঞার্থ হাতে পেলেই চলবে আপাতত।

বাক্যালাপ করতে গিয়ে তুমি যেসব কথা উচ্চারণ করছ – যেমন গাছ, পাখি, পুরুষ, মহিলা, পেড়, চিড়িয়া, আদমী, অওরত, ট্রি, ব্যর্ড, ম্যান, উওম্যন – সেগুলো সংকেতক বা সিগ্নিফায়ার। কাগজে আমি পর পর কয়েকটা অক্ষর বসিয়ে দিয়ে তোমার উচ্চারিত সংকেতক দেখিয়ে দিতে পারি। কিন্তু সেইসব আধার যার বাহন সেই আধেয় বা মানেগুলোকে ওভাবে চোখের সামনে আনতে পারি না।

একেকটা সংকেতক যে-ওজন বইছে সে-মানেটাকে বলা হয় তার সংকেতিত কিংবা সিগ্নিফাইড। কাগজে সংকেতিত বোঝাতে চাইলে কেউ কেউ বিশেষ কিছু একটা আঁকিবুকি কাটে। আমি বাংলায় এ-কাজ করতে বসে সচরাচর সংকেতকের ডানদিকে খণ্ড ‘ৎ’ বসিয়ে দিই। যেমন ‘পাখি’ সংকেতকটার যে-সংকেতিত, সেটা বোঝাবার জন্যে ‘পাখিৎ’ লিখি। সংকেতক আর সংকেতিত, এ-দুয়ে মিলে যে-পদার্থ, তাকে বলে সংকেত অর্থাৎ সাইন।

ভাষাতাত্ত্বিকের চোখে সংকেতের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার আপতিকতা। কোনো সংকেতকের সঙ্গে তার সংকেতিতের কোনো প্রকৃতিনির্দিষ্ট সম্পর্ক নেই। কথাটা আরেকভাবে বলতে পারি: স্বাভাবিক সংকেত বলে কিছু হয় না। কল্পনা করুন আপনি আমি এমন কোনো আজগুবি জগতে বাস করছি যেখানে ‘গাছৎ’ আধেয়টা প্রকাশ করতে চাইলেই সব মানুষেরই ‘গাছ’ বলতে ইচ্ছে করে, কেউ কখনও ট্রি কিংবা পেড় বলে না। সেই কাল্পনিক দুনিয়ায় ভাষাবৈচিত্র্যের কথা বলাই যেত না, কারণ ভাষায় ভাষায় কোনো হেরফের থাকত না। এমনকি আমরা সে-দুনিয়ায় ‘সমস্ত মানুষ বাংলা বলে’ এরকম বক্তব্য অবদিও পৌঁছতে পারতাম না। কারণ, ‘বাংলা’ বলে আলাদা কোনো ধারণা তৈরিই হত না আমাদের। যে-পৃথিবীতে ইংরিজি বা হিন্দি নেই সেখানে বিশেষ করে ‘বাংলা আছে’ এ-কথাটা আদপে বোধগম্যই হত না। কিন্তু আপনি তো জানেন, যে-বাস্তব জগতের আমরা সত্যিই বাসিন্দা সেখানে বাংলা ভাষার সংকেতিত ‘গাছৎ’, হিন্দির সংকেতিত ‘পেড়ৎ’ আর ইংরিজির সংকেতিত ‘ট্রিৎ’ এই তিনখানা জিনিস আধেয়গত বিচারে একই। অথচ তাদের আধারের উচ্চারণ তিন রকম, ‘গাছ, পেড়, ট্রি’। ভাষায় ভাষায় যে-তফাত সে-জায়গাটাকেই বলে ভাষার আপতিকতা।

বাংলা, হিন্দি, ইংরিজি – এরকম কোনো একটা বিশেষ ভাষার মঞ্চে নেমেই সংকেতক তার সংকেতিতকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন খেল দেখায়। সে-মঞ্চকে আমরা ভাষাতত্ত্বের পরিভাষায় বলি সংকেতন। গাছ, পাখি, পুরুষ, মহিলা এ-চারটে সংকেত তাহলে সেই সংকেতনের মঞ্চে অবতীর্ণ যার নাম ‘বাংলা’।

এটুকু বলা যদি যথেষ্ট হত তাহলে অবশ্য এই প্রবন্ধের কোনো প্রয়োজন থাকত না।

কোনো কোনো ভাষা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে শিক্ষিত মানুষেরা সে-ভাষায় দুভাবে কথা বলতে পারে। একটা ধরন সোজাসাপ্টা। বাচ্চারা কিংবা যেসব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লেখাপড়া শেখেননি তাঁরা সব সময় সেই ধরনটাতেই কথা বলেন। তাঁদের সঙ্গে যখন শিক্ষিতরা সুগম রীতিতে কথাবার্তা বলেন তখন সেসব কথা শিশুরা আর নিরক্ষরেরা বুঝতেও পারেন। কিন্তু সেই একই ভাষার দ্বিতীয় একটা দুর্গম বাচনরীতি রয়েছে। উচ্চশিক্ষার বইপত্র শিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্কদেরই সেখানে প্রবেশাধিকার। সে-বাচনরীতিতেই লেখা হয়। কোনো কোনো ভাষায় সুগম রীতির সঙ্গে দুর্গম রীতির এই তফাতের জায়গাটা একেবারে চোখের সামনে থাকে। যেকেউ দেখতে পায়। সমাজে সবাই স্বীকৃতি দেয় ব্যাপারটাকে। সেইসব সমাজের দৌলতেই ভাষাতত্ত্বের কারবারিদের একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সুগম আর দুর্গম রীতিতে দ্বিধাবিভক্ত এ-অবস্থাটার একটা নাম রাখা – দ্বিসংকেতন বা ডাইগ্লসিয়া – এবং তার রীতিনীতি বুঝতে চেষ্টা করা।

লেখাপড়ায় দীক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়াতেই যেখানে বাচ্চা বলতে শেখে ‘আম জাম পাকলে বলি হল পরিপক্ব/ মাথার নাম মস্তক আর বুকের নাম বক্ষ’, তখন সেই সমাজ নিজে নিজেই পাকা আম, মাথা, বুকের মতো কথাকে ‘চলিত বাংলা’ আর পরিপক্ব আম্র, মস্তক, বক্ষকে ‘সাধু বাংলা’ বলে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করে দেয় সেই শিক্ষাব্যবস্থাতেই। ওই দ্বিত্বটাকে আকৃত দ্বিসংকেতন অর্থাৎ ফর্মাল ডাইগ্লসিয়া বলে শনাক্ত করতে কারুর দেরি হয় না।

এ-জিনিস খালি বাঙালিদের একচেটে নয়। আরবি, গ্রিক, তামিল, তেলুগুর মতো বেশ কিছু ভাষায় রয়েছে আকৃত দ্বিসংকেতন। কিন্তু দ্বিসংকেতনের বিশ্লেষণের ব্যাপ্তি আর গভীরতা যত বেড়েছে তত ভাষাতাত্ত্বিকরা দেখতে পেয়েছেন যে ভাষার কায়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসে আছে দ্বিসংকেতনের বীজ। হেন মানুষ নেই যাকে দ্বিসংকেতনের সঙ্গে কারবার করতে হয় না। যদি ভেবে থাকি দ্বিসংকেতনমুক্ত ভাষা আছে তাহলে ভুল ভেবেছি।

বিষয়টার সূক্ষ্মতম খুঁটিনাটিতে যাবার দরকার নেই এ-যাত্রা। এটুকু মনে রাখাই যথেষ্ট যে মধ্যযুগের ইউরোপে উচ্চ মার্গের দুর্গম বাচকতার মাধ্যম ছিল ল্যাটিন, কিন্তু সাধারণ কথাবার্তা চলত বিভিন্ন স্থানীয় ভাষায়। ওই ধরনের সমাজে দ্বিসংকেতনের সঙ্গে দ্বিভাষিক অবস্থার হাত ধরাধরি ছিল বলা চলে। মধ্যযুগের ভারতবর্ষেও অনেক দিন প্রাদেশিক ভাষাসমূহের সঙ্গে দুর্গম সংস্কৃতের একই ধরনের সহাবস্থান ছিল। পরে প্রশাসনের কাজে সংস্কৃতের জায়গায় ফারসি ভাষা চালু করা হয় বিভিন্ন ইসলামপ্রধান রাজত্বের সময়ে। এ-নাট্যশালায় ইংরেজদের প্রবেশের পর একটু একটু করে ইংরিজি জায়গা করে নেয় ভারতীয় দ্বিসংকেতন তন্ত্রের দুর্গম অঞ্চলে।

আজকের ভারতেও একথা বলা ভুল হবে যে বিশেষ কোনো এলাকার অধিবাসীরা জন্মসূত্রে ইংরিজিভাষী অর্থাৎ পেট থেকে পড়েই ইংরিজি শেখে। দুচারটে সেরকম অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান পরিবার নেই তা নয়। কিন্তু তাদের প্রায় আঙুলে গোনা যায়। ভারতে ইংরিজি যাঁরা বলেন তাঁরা প্রায় সকলেই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরিজি শিখেছেন, যদিও এঁদের অনেকেই ভাষাটা দস্তুরমতো রপ্ত করেছেন, করবেনই তো, দ্বিসংকেতনের ব্যবস্থাপনায় ইংরিজির ভূমিকা-যে তাঁদের কাছে খুবই জরুরি।

এতক্ষণ এমনভাবে কথা বলেছি যেন দ্বিসংকেতন বলতে সর্ব দেশে সর্ব কালে একেবারে একই জিনিস বোঝায়। কিন্তু প্রাচীন কালে আর মধ্যযুগে জ্ঞানমঞ্চের ক্রমবিবর্তনের দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে মধ্যযুগের ভারতবর্ষে মস্ত বড়ো একটা পালাবদল ঘটেছিল। দ্বিসংকেতনের ভরকেন্দ্র দুর্গম রীতি থেকে সুগম রীতিতে সরে আসে। সেই সুগমরীতিকেন্দ্রিক নতুন ব্যবস্থাই এখনও চলছে বলে আজকের দিনের ভারতীয়রা যে যার নিজের স্থানীয় ভাষার মাধ্যমে যে-পরিচিতি অর্জন করেছেন সেই বাঙালি গুজরাটি ওডিয়া পাঞ্জাবি নাগা খাসি মিজো অসমিয়া পরিচিতিতে স্থৈর্য রক্ষা করেও দেশের আর-সবার সঙ্গে দুর্গম ইংরিজিতেই কাজকর্ম করে থাকেন। তাতে তাঁদের পরিচিতি রক্ষায় কোনো ব্যাঘাত হয় না।

এ-বিশ্লেষণ যিনি স্বীকার করেন তিনি এও মানবেন যে ভারতের বিভিন্ন সমবায় ইংরিজিকে একরকম সিংহাসনে চড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই সিংহাসনটাকে অলংকৃত রেখেই তারা একরকম প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে রেখেছে। ইংরিজির সঙ্গে ওই দূরত্ব না রাখলে ভারতীয়দের মাথার ভেতরে ঢুকে এসে সে-ভাষার সমস্ত আদবকায়দা আমাদের সাংস্কৃতিক নিভৃতিটাকে খেয়ে ফেলতে পারত।

ইংরিজিকে সরিয়ে রাখার এই আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল উনিশ শতকেই। যা যা সাংস্কৃতিক সামগ্রী ইংরেজদের কাছ থেকে নিতে চাই সেসব এক ধার থেকে আমাদের ভাষায় অনুবাদ করে করে আমরা বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ খাটাচ্ছিলাম। ইংরিজি থেকে ভারতীয় ভাষায় উচ্চমানের প্রচুর অনুবাদ হতে থাকলে সেই সমৃদ্ধ মানসিক স্বগৃহ ছেড়ে ইংরিজি ভাষার তৈরি হোটেলে থাকার সুযোগটা ভারতীয়দের চোখে প্রলোভনের মতো দেখাবে না।

কোনো কোনো বিশ্লেষণকারীর মনে হয়েছে ভারতে ইংরিজিরও আলাদা ঘর আছে একথা বলা জরুরি। ইংরিজিভাষীরা বিশেষ কোনো এলাকায় বসবাস করে না একথা সত্যিই বটে, কিন্তু তাতে কী, আসলে ওটাও আধুনিক ভারতের একটা মাতৃভাষা, এই দেখো না, ওই ভাষায় আমাদের কোনো কোনো লেখক কীরকম উৎকৃষ্ট বই লেখে, নিজেদের ভাষা না হলে পারত কি?

কথাটা কেন আমি মানি না – কেন তার বদলে আমি ‘ইংরিজি ভারতে মাতৃভাষা নয়, মাসির ভাষা’ বলে একটা অন্য ঘরানার বক্তব্য দাঁড় করাবার চেষ্টা করে চলেছি কয়েক দশক ধরে – সেটা খুলে বলতে চাইলে ধাপে ধাপে বলা দরকার।

প্রশ্নটার দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে বিশ্লেষণ লেখার প্রথম সুযোগ পাই যখন ১৯৭৭ সালে বিশ্ব এসপেরান্তো সম্মেলনের আয়োজকদের নিমন্ত্রণে আমি রেইকইয়াভিক-এ ‘ভারতে ইংরিজির অবস্থান’ নিয়ে বক্তৃতা দিই। আন্তর্জাতিক সেতুভাষা এসপেরান্তোর বিশ্ব সম্মেলনে প্রত্যেক বছর উচ্চশিক্ষার কিছু অধিবেশন থাকে। তখন তার নাম ছিল ‘গ্রীষ্মকালীন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় বক্তৃতামালা’। সেই পর্যায়ে বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছিল আমাকে। কাজটা মনে হয়েছিল খুবই শক্ত। ঠিকই মনে হয়েছিল। ভয়ে ভয়ে আমার চেনা একজন ইতিহাসের অধ্যাপককে জিগেস করেছিলাম, ‘এ-বিষয়টা নিয়ে পড়বার মতো যা আছে সে-বই নিশ্চয়ই ভারত থেকে আনিয়ে নিতে হবে?’, সেই অধ্যাপকটি উত্তরে বললেন, ‘তোর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বোধহয় পেয়ে যাবি এরিক স্টোকস-এর লেখা “দি ইংলিশ ইউটিলিটেরিয়ান্স অ্যাণ্ড ইণ্ডিয়া”, তাতেই কাজ হয়ে যাবে’, তুইতোকারির কারণ অধ্যাপকটির নাম অরুণকুমার দাশগুপ্ত, আমার বাবা। বইটা পড়ে পেয়ে গিয়েছিলাম ভারতে ইংরিজি শিক্ষার প্রবর্তনের এক আর্থ-সামাজিক ব্যাখ্যা। সে-বিশ্লেষণের সঙ্গে এসপেরান্তো ভাষার কর্মীদের বিশিষ্ট দৃষ্টিকোণের সংযোগ স্থাপন করে ভাষার সঙ্গে ক্ষমতার মোলাকাতের জায়গাটা নিয়ে নিজস্ব ভাষ্য রচনার কাজ শুরু করে দিই ১৯৭৭এর বসন্তকালে।

ফিরে তাকালে দেখতে পাই, ওই গবেষণাতেই কায়াবাদী সমাজভাষাতত্ত্বের সূত্রপাত। কাকে বলে কায়াবাদ?

আমি তার আগের বছর বাংলা ভাষার যৌগিক ক্রিয়াপদে মেরু ক্রিয়া আর দিশারি ক্রিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ব্যাকরণের যে-বিশ্লেষণরীতি অবলম্বন করি, তার মোদ্দা কথাটা ছিল – ভেবো না যে এইখানে রক্ত থাকে, ওইখানে মাংস, সেইখানে চামড়া, তিন জায়গা থেকে এনে বেঁধে গেঁথে শরীরের রচনা। তার বদলে বুঝতে শেখো যে, একটা শরীরকে তার আস্ত শরীরত্বে চিনতে শিখলে তবে বুঝবে অন্য শরীরের সঙ্গে তার আত্মীয়তা কীভাবে রক্তে সাড়া তোলে, চামড়ায় শিহরণ জাগায়, হাড়কেও কাঁপিয়ে দেয়। শরীরটাকে যদি চিনতে চাও তাহলে টুকরো টুকরো করে কেটে কিছু পাবে না। ‘এই নে বুক, মুখ, হাত নে, পা নে,/ ভাবিস পাবি তবু আমার মানে?’

সমাজভাষাতত্ত্বে এ-ভাষ্যের অবতরণ ঘটে যখন আমাদের চোখে পড়ে যে একেকটা ভাষার বিশেষ বিশেষ সংকেতন যখন মিলে মিশে দ্বিসংকেতনের শরীরত্বে বিধৃত রয়েছে তখন তাদের কেটে আলাদা করে কোনো ভাষ্য দাঁড়াবে না। যে যার বাসায় যেভাবে বাস করে তার স্থৈর্যের অটুট সম্মান রক্ষা করে অনুবাদমূলক সেতু নির্মাণের পন্থাতেই বিশ্লেষণ এগোতে পারবে। এ-কাজের মূলসূত্র হল, ভাষায় ভাষায় যে-সম্পর্ক সেটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ইন্দ্রিয়সর্বস্ব আকরণিক সম্বন্ধ নয়। কথাবার্তার আর বাচকতার সক্রিয় মানবিক সংযোগই সেখানে প্রধান। তাই সেতু তৈরি করে চলাচলের ওপর জোর দেওয়াটাই আসল কথা। সেতুবাদের দিকে, নিরপেক্ষতার দিকে, ভাবের অবাধ লেনদেনের দিকে এসপেরান্তোভাষীদের মূল ভাবনার যে-ঝোঁক, তার সঙ্গে কায়াবাদের সাযুজ্য স্পষ্ট ঠিকই। কিন্তু আমি যৌগিক ক্রিয়াপদের কিংবা ভারতে ইংরিজির অবস্থানের ভাষ্য লিখতে বসে এসপেরান্তো ভাবনীতির সূত্রে ধরে এগোইনি। কায়াবাদের উৎপত্তিতে এসপেরান্তোর কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। কায়াবাদী ব্যাকরণতত্ত্বের ইস্তাহার হিসেবে ‘আফটার এটিমোলজি’ উল্লেখযোগ্য (দাশগুপ্ত, ফোর্ড আর সিং ২০০০)।

সেই-যে এসপেরান্তো ভাষায় সাতাত্তর সালে বক্তৃতা দিয়েছিলাম, সেই বক্তব্য পরবর্তী কালে ইংরিজিতেও খুলে বলার অবকাশ পাই। তখন খুলে বলতে পেরেছি যে দ্বিসংকেতনের মূল চাবিকাঠি ভাষার আকৃত সংকেতনের নির্মিতিতে নেই। আছে ভাষীদের হালকা থেকে ভারি নানা রঙের নানা ওজনের বাচকতার চলাফেরায়। দ্বিসংকেতন আদৌ শব্দের সঙ্গে শব্দের আমলাতান্ত্রিক সমীকরণের হিসেব নয়। মানুষের কথাবার্তার সঙ্গে ভিন মানুষের কথাবার্তার সেতুসন্ধানের কাহিনি। দ্বিসংকেতন না বললে দ্বিবাচকতা বললে সুবিধে হয় বুঝতে।

আমার ভাষ্যটা যখন গ্রন্থাকারে বেরোয় (দাশগুপ্ত ১৯৯৩) তখন-যে পাঠকসমাজ তৈরি ছিল সেটা পাঠকদেরই কৃতিত্ব, তাতে আমার কোনো অবদান নেই। ‘মাসির ভাষা’ বিশ্লেষণটা এত লোকের এমন সহৃদয় অভ্যর্থনা পাবে এটা আমি ভাবতেও পারিনি। এদেশে ইংরিজির অবস্থান বিষয়ক মনোযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে বইটাকে যেভাবে জায়গা দেওয়া হল তাতে একটু অবাকই হলাম। যাই হোক, বিষয়টি নিয়ে যাঁরা আগ্রহী তাঁরা অনেকেই এই ‘মাসির ভাষা’ কথাটা শুনেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। এবার হয়তো তাঁরা মন দিয়ে দ্বিসংকেতনের সঙ্গে এ-ভাষ্যের সংযোগের জায়গাটা অনুধাবন করে এখন বিষয়টা নিয়ে নতুন করে ভাবতে রাজি হবেন। ভাবতে গিয়ে তাঁরা যদি সিদ্ধান্ত নেন যে আমার কথাটাকে এবার খারিজ করে দেবেন তাতে কোনো মুশকিল নেই। প্রশ্নটা সত্যাসত্যের, আমার কথা বনাম অন্য কারুর কথার বিবাদ নয় এটা।

পাঠকের গ্রহণ-বর্জনের কাজের পথ সুগম করবার জন্যে আমি গ্রন্থপ্রকাশের অল্প দিন বাদে তার প্রধান প্রধান বক্তব্যের যে-সারসংক্ষেপ করেছিলাম (দাশগুপ্ত ১৯৯৮) তার তরজমা আপনাদের সামনে পেশ করে নিয়ে তারপর ফিরে আসব বক্ষ্যমাণ রচনার কর্মসূচিতে।


।।ইং রি জি    আ র   ভা র তী য়  ভা ষা:   ভি টে – ভা ষা – ভি ত্তি ক    বি শ্লে ষ ণ।।

বর্তমান ভাষ্যের সানুপুঙ্খ উপস্থাপন পেশ করা হয়েছে অন্যত্র (দাশগুপ্ত ১৯৯৩)। আশা করি সে-বইয়ের বর্তমান সারসংক্ষেপে কয়েকটি বক্তব্য যেভাবে দাখিল করা হল তাতে পাঠকদের লাভ হবে, বিশেষ করে যাঁরা সমালোচনা করতে চান তাঁদের।

১। ভাষাতাত্ত্বিকরা যখন বলেন আমরা কিছু শব্দ অন্য ভাষা থেকে ‘ধার’ নিয়েছি, তখন ধরে নেওয়া থাকে নিজস্ব শব্দসম্ভারকে আমাদের একরকম সাংস্কৃতিক ভিটেমাটি বলে গণ্য করতে পারি। এই ভিটেমাটিতেও খোঁড়াখুঁড়ি করলে নিশ্চয়ই বেরোবে মাটির প্রত্যেক স্তরের বয়স সমান নয়। তাহলেও নবাগত শব্দগুলো যে-মৃত্তিকার আতিথ্য পাচ্ছে সে-মাটিটাকে মোটের উপর ভিটেমাটি বলে শনাক্ত করলে নিজের আবাদ আর পরের আবাদের মস্ত কোনো ভুল পরিচয় দেওয়া হবে না। এভাবে হিসেব করলে ইংরিজি ভারতের ভিটে-ভাষাগুলোর কোঠায় পড়ে না, এদেশে ইংরিজিকে ধার নিয়েছি আমরা।

২। অবশ্য কিছু কিছু ভারতীয় আছে যাদের ভিটেমাটি পালটে গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ইংরিজিভাষী পশ্চিমে দীর্ঘকাল কাটিয়েছে বা কাটাচ্ছে (অথবা সেরকম কোনো দেশের সঙ্গে পূর্ণমনস্ক নিয়মিত যোগাযোগ রাখে)। সেই ভারতীয় ব্যক্তিদের জীবনে ইংরিজি ভিটে-ভাষা বলে গণনীয়। সংস্কৃতির গণনায় ধরা যায় তারা পশ্চিমে যোগ দিয়েছে।

৩। ইংরিজিতে ওই বর্গের মানুষেরা যখন সাহিত্য রচনা করে তখন ওদের ওইসব বয়ানের সঙ্গে আন্তর্বয়ন ইংরিজিরই অন্যান্য বয়ানের; ভারতীয়দের রচনাবলির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না সে-হিসেবের। ইংরিজি সাহিত্যের ধারার উপধারা হিসেবে বইতে থাকে ওদের লেখাগুলো। ইঙ্গভাষী দুনিয়ায় একরকম ‘গেটো’র পরিচিতি লাভ করে, অর্থাৎ মূলস্রোতের সঙ্গে অসম্পৃক্ত পৃথগন্ন পাড়ার পরিচিতি।

৪। ও-পাড়ায় যত অট্টালিকাই নির্মিত হোক না কেন, তা সত্ত্বেও ওই রচনাধারা সেই অর্থে অসন্তত থেকে যাবে, সাংস্কৃতিক বংশরক্ষায় অসমর্থ থেকে যাবে, যে-অর্থে ঘোড়া বা গাধা বংশরক্ষা করতে পারে কিন্তু খচ্চর তা পারে না। ‘ভারতীয় ইংরিজিতে রচিত সৃষ্টিকর্ম’ আর আধুনিক যুগের প্রকৃত স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত সাহিত্যধারার একটা জরুরি তফাত এইখানে দেখতে পাই আমরা – কাম্যু-র সঙ্গে তাঁর আধুনিকতার ভাষ্যকার বার্তের কিংবা বালিবারের যে-সম্পর্ক চোখে পড়ে সেভাবে কোনো ভারতীয় ইংরিজি সাহিত্যস্রষ্টার হয়ে সেই বর্গের অন্য কোনো রচয়িতা অবিচ্ছিন্ন বা প্রবহমাণ চিন্তাশীল ভাষ্য রচনা করেন না। অর্থাৎ আন্তর্বয়নের বাচকীয় ভাষ্যের পন্থায় ‘ভারতীয় ইংরিজি সাহিত্য’ নিজের বংশরক্ষা করে না – ইংরিজি সাহিত্যের বৃহত্তর সাহিত্যশালার ধ্বনি-প্রতিধ্বনির দিকেই সে নীরবে দেখায় অঙ্গুলি তুলি।

৫। এখানে ভারতের ভিটেমাটির নিজস্ব ভিটে-ভাষায় রচিত সাহিত্য নিয়ে কথা বলছি না। সেইসব সাহিত্যের বংশরক্ষার সামর্থ্যের প্রতিপাদন অনেক দিন ধরেই পাওয়া গেছে। ইংরিজিতে ভারতীয়দের যে-রচনাধারা ‘সন্তত’ অর্থাৎ অবিচ্ছিন্ন বংশরক্ষার সামর্থ্য দেখিয়েছে তা হল, ধার-নেওয়া এই ভাষায় এদেশের লোকেরা যেসব বাচকীয় রচনা করে গেছে, যেখানে সৃষ্টিটা প্রধান নয়, মননধর্মিতাই প্রধান, সেই কাজের প্রবাহ। সেসব লেখার বর্ণচ্ছটা রাজনীতি থেকে আধ্যাত্মিক অদ্বৈতমার্গ হয়ে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পর্যন্ত বিস্তৃত। ইংরেজদের কাছে ন্যায়বিচার চেয়ে দীর্ঘ আইনমূলক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে দাদাভাই নওরোজির, রমেশচন্দ্র দত্তের, মহাত্মা গান্ধির যে-পরিস্ফুটনের কৃতিত্ব পর পর দেখা গেছে তাকে খালি ইংরিজিতে ভারতীয়দের রচনার মননধর্মী বাচকীয়তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ভাবলে চলবে না। লক্ষ করা দরকার যে ওই পরম্পরার প্রবহমাণতা থেকে প্রমাণ হয় যে ওই ধারাটা নিজেকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

৬। ভারতের ভিটেমাটির বিভিন্ন ভাষা থেকে এখন উঁচুদরের সাহিত্যের ইংরিজি অনুবাদ পর পর বেরোচ্ছে। এইসব অনুবাদের অবস্থান ঠিকমতো বুঝতে চাইলে এদের সঙ্গে মননধর্মী বাচকীয় আত্মপ্রকাশের প্রবাহের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা চিনে নিতে হবে, নইলে এ-অনুবাদকেরা নিজেদের অস্তিত্বের আর কাজের অবিচ্ছিন্ন যুক্তিসহ ভাষ্য দিতে পারবেন না। একবার যদি বিশ্লেষণমূলক বাচকীয় প্রবাহের এ-জায়গাটাতে অনুবাদের কাজের ধারাকেও বসাতে পারি তাহলে বুঝতে পারব যে ভারতীয়রা নিজেদের কোনো কোনো লেখাকে-যে ‘সৃষ্টিশীল রচনা’ বলে গণ্য করেন সেগুলোও এই অনুবাদকর্মেরই অঙ্গবিশেষ, এবং অনুবাদের কাজটাও বৃহত্তর বিশ্লেষকীয় প্রবাহের অন্যতম ধারা বলে গণনীয়।

৭। বিশ্লেষণমূলক এই বাচকীয় ধারাটাকে আমাদের ভাষ্যের কেন্দ্রে যদি এভাবে বসাতে পারি তাহলে আর ভাবতে বসব না, ভারত কেন ইংরিজি ব্যবহারের নিজস্ব জাতীয় প্রতিমান নির্মাণ করে তার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা বা ও-ভাষায় বইপত্র প্রকাশের ব্যবস্থা চালায় না; অর্থাৎ ইংরিজির স্বতন্ত্র অভিধান কিংবা ব্যাকরণ কেন ভারত থেকে বেরোচ্ছে না তা নিয়ে আর বিস্ময় প্রকাশ করব না। ভারতীয়রা যখন মন দিয়ে ইংরিজি বলতে বা লিখতে চায় তখন-যে তাদের যত্নের ধরনগুলো ইংলণ্ড আমেরিকার মতো মহানগরস্থানীয় দেশের অভিকর্ষক্ষেত্রে প্রবেশ করে এ নিয়েও তখন আর আক্ষেপ করতে চাইব না আমরা। আমরা যদি বিশ্লেষকীয় কাজ করবার জন্যে কোনো চিহ্নতন্ত্র অন্যদের কাছ থেকে ধার নিই – যেমন রাসায়নিক পদার্থের প্রতীক যদি আন্তর্জাতিক কোনো পর্ষদের প্রতীকতন্ত্র থেকে গ্রহণ করি – তখন তো ধরে নেবই যে সেই তন্ত্র বলবৎ রাখার এবং মাঝে মাঝে তার সূত্রের বিবর্ধন আর রদবদলের দায়িত্ব সেই বাইরের কর্তৃপক্ষের হাতেই ন্যস্ত থাকবে, ওটা আমাদের দায়িত্ব নয়। এও তেমনি। ধরা যাক ক্রেতা বা অধমর্ণ হিসেবে আমাদের শিক্ষার্থীদের দরকারের কথা ভেবে আমরা বাংলা পাঠ্যবইয়ে অক্সিজেন অর্থে O আর হাইড্রোজেন অর্থে H-এর গায়ের ওপর বাংলা সংখ্যাচিহ্ন ২ কিংবা ৩ চাপিয়ে দিতে রাজি থাকি, সেটুকু নিজেদের দায়িত্বেই করি, আন্তর্জাতিক রাসায়নিক পর্ষদকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত না করে – আমাদের দেশের দরকারের সঙ্গে সেই খাপ খাইয়ে নেওয়াটুকু করছি বলেই আমরাও ওই ধার-নেওয়া তন্ত্রের মালিক বলে ভাবতে শুরু করব, এভাবে তো লেনদেনের বা মালিকানার যুক্তি চলে না। অবশ্য যে-ভারতীয়রা ভিটেমাটি পালটে আদতে ইংরিজিভাষী হয়ে গেছে তাদের কথা স্বতন্ত্র, ২ নম্বর সূত্র দ্রষ্টব্য।

৮। আবার এটুকু বলা নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয় যে ভারতীয়রা ইংরিজির মাধ্যমে মননধর্মী লেখার কাজে ব্যাপৃত – মানুষের কোনো কাজই তো নিছক হয় না, জানতে চাওয়া দরকার এই কাজটার পিছনে কী ধরনের ছক সক্রিয়, ইংরিজিতে যখন ভারতীয়রা মননশীল কিছু লেখে তখন কোন্‌ বড়ো মাপের উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে কাজের সেই ধারাটাকে বসালে তাদের নিজস্ব অনুধাবনের সঙ্গে সামাজিক ভাষাতাত্ত্বিকের ভাষ্যের সামঞ্জস্যসাধন সহজ হবে। এ-প্রশ্নের কোনো নিষ্কণ্টক জবাব হয় না। কেউ আদি দৃষ্টান্ত হিসেবে গান্ধিকে তুলে ধরবেন, কারুর বা রজনী পাম দত্তর দিকে কিংবা নেতাজির দিকে ঝোঁক, কেউ বা বলবেন মানবেন্দ্রনাথ রায়কে কষ্টিপাথর হিসেবে বরণ করেই বিচার করা উচিত এ-কাজের কোন্‌ ধারা আসল এবং কোন্‌ ধারা ফালতু। এসব তর্কবিতর্কে আমরা বড়োই চট করে জড়িয়ে যাই – খেয়াল করি না যে উল্লিখিত মনীষীরা সকলেই কোনো না কোনো ধরনের জাতীয়তাবাদের আদলের প্রবক্তা ছিলেন, প্রত্যেকেই বিশেষ করে ভারতের পক্ষে আধুনিক দেশ হওয়া বলতে কী বোঝায় এই এক তথা অদ্বিতীয় প্রশ্নেরই নানারকম উত্তরের উনিশ বিশ নিয়ে পাঞ্জা লড়ছিলেন বিভিন্ন পক্ষ প্রতিপক্ষ সাজিয়ে।

৯। ভারতে আধুনিক মনের সূত্রপাত কবে? নির্দিষ্ট কোনো সনতারিখ দিয়ে তো এরকম প্রশ্নের যুক্তিসহ উত্তর দেওয়া যায় না। সমাজে পরিবর্তন হতে থাকবে ধরে নিয়েও যে-সংস্কৃতি নিজস্ব রীতি বজায় রেখে বংশরক্ষা করতে জানে তাকেই যদি আধুনিক বলি, তাহলে আধুনিক ভারতের বিশেষ নিজস্ব রীতির গোড়াপত্তন ঘটে মধ্যযুগের সেই পালাবদলে যাকে অনেকে ভক্তিচিহ্নিত হিন্দু ধর্ম বা সুফি আদলের ইসলাম বলে চেনেন। ওই সময়ে পুরুতদের সংস্কৃত আর রাজাগজাদের ফারসির সঙ্গে কথাবার্তায় প্রচলিত ভিটে-ভাষাসমূহের সম্পর্ক আমূল পালটে যায়। ভারতের সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের চাবি ওই সময়ে গগনমার্গী উচ্চবর্গের হাত থেকে চলে আসে মাটিতে পা ঠেকানো সাধারণ মানুষের হাতে।

১০। এদিকে ইংরিজি যেদেশে ভিটেমাটির ভাষা নয় সেদেশে তো দ্বিসংকেতন-বিদ্ধ সাংস্কৃতিক বন্দোবস্তের দুর্গম উচ্চাসনে বসা ছাড়া ইংরিজির আর কোনো গতি নেই। আমরা অনেকেই মনে করি ইংরিজির সাহায্যে আমাদের নানারকম উপকার হতে পারে। ধরে নেওয়া যাক কথাটা অমূলক নয়। তাহলেও ওই উপকার যাতে আরও বেশি কার্যকর হয় তার জন্যে খুঁজে দেখা দরকার আমাদের নিজস্ব ভিটে-ভাষাগুলোর উঁচু নিচু আনাচে কানাচে কী ঘটছে না ঘটছে। ওখানেই তো ভারতীয় আধুনিকের দরকষাকষি চলছে। অর্থাৎ আমাদের ইংরিজির চর্চা কী করে আমাদের ভিটে-ভাষাগুলোর চর্চার মুখাপেক্ষী হতে পারে, সে-ব্যবস্থা করতে শিখতে হবে। নইলে কাজটা এগোবে না।

১১। বর্তমান যুক্তি থেকে এও প্রতিপন্ন হয় যে, ৮ সংখ্যক বক্তব্যে ভারতের যে-বিশেষ নিজস্ব আধুনিক মেজাজের উল্লেখ ছিল, ৪ সংখ্যক বক্তব্যে যার ইংরিজিভাষী সংস্করণের আত্মচেতনার অভাবের কথা বলা হয়েছিল, সেই মেজাজের শ্রীবৃদ্ধির কাজ একমাত্র ১০ সংখ্যক বক্তব্যে যাকে আমাদের ‘ভিটেভাষার চর্চা’ বলা হয়েছে সে-জায়গাতেই করা সহজ, কারণ সেখানেই বিভিন্ন মহলের অভিজ্ঞ মানুষের সমাবেশ একইসঙ্গে এ-কাজে আগ্রহী এবং পারঙ্গম।

১২। একদা আধুনিকতা অনেক মানুষকে সরল বিশ্বাসে দীক্ষা দিয়েছিল। সে-বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক চেহারা বলত, প্রযুক্তির বিবর্তনে নিশিদিন ভরসা রাখিস, হবেই হবে মানবজাতির চরম প্রগতি, পৌঁছে যাবই যাব সব পেয়েছির দেশে। তার দোসর ছিল কিছু কিছু সাহিত্যিকের অর্ধচিন্তিত বিশ্বমানবীয় আধুনিকবাদ, যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে তিরিশের দশকে। ওই কার্যক্রমের উভয় চেহারাতেই আধুনিকতার মেজাজ এক ধরনের নিদর্শবাদী বা এমপিরিসিস্ট ব্যবস্থাপনের ভাবনীতিকে সর্বজনীন কাণ্ডজ্ঞান বলে বরণ করেছিল। এদিকে এই ধরনের নিদর্শবাদের দাপট এমনিতেই দেখা গেছে কয়েকশো বছর ধরে প্রধানত ব্রিটেনের সমাজে এবং ভাষায় – আধুনিকতার দৌলতে সে-জিনিস ছড়িয়ে গেল সারা পশ্চিমে। বিভিন্ন পশ্চিমি শক্তির মধ্যে তাকে নিরপেক্ষ দেখায় বলে তাকে গ্রহণ করতে তৃতীয় বিশ্বের উচ্চবর্গের চিন্তাশীলরাও রাজি হয়ে গিয়েছিলেন; ভাববিনিময়ের একটা কিছু নিশ্চিন্ত ভিত্তি থাকলে যে-সুবিধে হয় তার আকর্ষণে লোকেরা নেই-কড়ির চেয়ে কানাকড়িকেও বরণীয় মনে করতেই পারে, এতে অবাক হবার কী আছে। তবে আজ তো যুগ পালটাচ্ছে। আধুনিকতার মূলমন্ত্র যে-উন্নয়ন তাকে জনসাধারণের পছন্দের কাছে নত হতে বাধ্য করার যে-অধুনান্তিক তাগিদ আজ আমাদের কর্মসূচি বদলাতে বলছে সেই সূত্রে আজকের ভারতীয়দের হাতে আসছে বিভিন্ন দাপটের প্রতিরোধ করবার মতো সাহস, সম্বল, সরঞ্জাম। নিদর্শবাদ-বিদ্ধ ইংরিজি ভাষা তথা সাহিত্যের কারখানা সেইসব দাপুটে শক্তির গোত্রভুক্ত যাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আমরা এবার অবশেষে সত্যিসত্যিই পারব। কিন্তু অধুনান্তিকতা ব্যাপারটাও সকণ্টক। আমরা যারা অধুনান্তিকের অঞ্চলবাদী ভাষ্যের শরিক, যারা ভারতের নিজস্ব আধুনিকতার যাত্রা অব্যাহত রাখার উপায় খুঁজছি, তাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হল পোশাকি অধুনান্তবাদের ফ্যাশনমনস্ক বাগভঙ্গির আতিশয্য।

সেই আতিশয্যের জাল কেটে বেরিয়ে এসে কোনো কোনো বড়ো মাপের কর্মী – যেমন গায়ত্রী স্পিভাক আর দীপেশ চক্রবর্তী – আমাদের মনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি যে-ঘরানার কর্মী তাকে বলি ‘অধুনান্তজ’, ট্রান্সমডার্ন। এ-বিষয়ে আরও বাক্যব্যয় করেছি আমার ‘ছিন্ন কথায় সাজায়ে তরণী’ গ্রন্থে (কলকাতা: গাঙচিল, ২০১১)। হঠাৎ ২০১১-য় পা দিচ্ছি দেখে, এবং বর্তমান অনুচ্ছেদের আদিতে ‘১৩’ সংখ্যাটা নেই লক্ষ করে, সতর্ক পাঠক আন্দাজ করে থাকবেন যে সংখ্যাঙ্কন থামিয়ে দিয়েছি ‘দি আদারনেস অভ ইংলিশ’ বইয়ের সারসংক্ষেপের সেই মূল বয়ানটার অনুবাদ শেষ হয়ে গেছে বলে। শুরু হয়ে গেছে বর্তমান মুহূর্তের উপযোগী সংযোজনের কাজ। যাঁরা পোশাকি ভাষাতত্ত্বের মূলসূত্র দেখে নিতে চাইবেন তাঁদের কাজে লাগবে ‘ভাষার বিন্দুবিসর্গ’ বইটাও (কলকাতা: গাঙচিল, ২০১২)।

অধুনান্তজ কার্যক্রমের সহকর্মী হতে হয়তো এগিয়ে আসবেন এমন অনেকে যাঁরা প্রথম দর্শনে আমাদের ঘরানার সঙ্গে খাস অধুনান্তবাদী আতিশয্যকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তফাতের একটা জায়গা এই যে অধুনান্তজ ভাবনা পরিবেশবাদী এবং সেইজন্যে বিজ্ঞানকে নিশ্চিন্ত প্রযুক্তিবাদের গ্রাস থেকে বাঁচাতে উদ্‌গ্রীব। যেসব চিন্তাশীল বৈজ্ঞানিক আধুনিকতাকে বৃহত্তর চিন্তার প্রাঙ্গণে স্থান দেবার অভিপ্রায়ে ইহবাদ অর্থাৎ সেকুলারিজমের মননরীতির শ্রীবৃদ্ধির প্রয়াসে নিযুক্ত তাঁদের কথা ভাবছি বিশেষ করে।

ইহবাদীরা জানেন, মাটিতে যে-মানুষ চলে ফেরে, মেঘের আড়াল থেকে আকাশবাণী বিতরণ করে তার শাসনের কাজ চলতে পারে না। আইনের শৃঙ্খলমুক্ত মগের মুল্লুক-জাতীয় স্পেশাল ইকোনমিক জোনে দরিদ্র আর নিরক্ষরদের শোষণ করে নিজেরা আরামের সিংহাসনে বসে থেকে যে-ইংরিজির নিদর্শবাদী প্রবক্তারা পৃথিবী চালানোর দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের তাসের ঘর কোনো একদিন চোখের সামনে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে কিনা সেটা প্রশ্ন নয়। আর্থসামাজিক সংকটে জর্জরিত হয়ে, পৃথিবীর উষ্ণায়ন আর পরিবেশদূষণের প্রকোপবৃদ্ধির ফলে বিশ্বাস্যতা হারিয়ে, ভোগবাদী ধনতান্ত্রিক জীবনরীতি দেউলে হয়ে যাবে কিনা সেটাও জিজ্ঞাস্য নয়। যে-প্রশ্ন সত্যিই বিবেচ্য তা হল, ভেঙে যখন পড়বে তখন যাতে সকলে বাসযোগ্য কোনো বিকল্পে অবিলম্বে প্রবেশ করতে পারে সেজন্যে আমরা যারা পরিবেশবাদী তারা কতটা সুচিন্তিত বিকল্পের প্রস্তুতির কাজ গুছিয়ে রাখতে পারছি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে এসপেরান্তো নিয়ে ভাবতে আমি সেই ভারতীয় চিন্তাশীলদেরও বলব যাঁদের নিজেদের এসপেরান্তো শিখবার সময় বা প্রবৃত্তি হবে না। পরিবেশবাদীদের কাঙ্ক্ষিত নতুন বিশ্বে আমরা ভাষার ব্যাপারে কী স্বপ্ন দেখব? ভোগবাদী বিশ্বে ইংরিজি ছিল, লোভকে জয় করার পর বাস্তববাদী পরিবেশ-সংরক্ষণ-সচেতন দুনিয়ায় তার স্থলে এসপেরান্তো অভিষিক্ত হবে, এই কি আমাদের আন্দোলনের সুসমাচার যা দিকে দিকে প্রচার করে বেড়াচ্ছি?

যে-পাঠক এটাকে আমাদের অবস্থান বলে মনে করেন তিনি স্পষ্টতই জানেন না যে দেশে দেশে ভাষা সমস্যার প্রকোপ বৃদ্ধি দেখে, যাদের ভাষা অবহেলিত তাদের নিপীড়িত বোধ করার জায়গাটাতে এখনকার সামাজিক বিদ্যার সরঞ্জামে যথোচিত সংবেদ সহকারে চিন্তাশীলরা পৌঁছোতে পারছেন না দেখে, বিশ্ব এসপেরান্তো সংস্থা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ষাটের দশকে ভাষা-পরিকল্পনা বিষয়ক সমাজভাষাতত্ত্বের জন্যে আস্ত একটা নতুন কাগজ চালু করেছিল, লিংহ্বাই প্রোবলেমোই কাই লিংহ্বো-প্লানাদো, ল্যাংগুয়েজ প্রবলেমস অ্যাণ্ড ল্যাংগুয়েজ প্ল্যানিং। ইংরিজি ফরাসি জার্মান রুশ ইটালিয়ান প্রভৃতি ভাষায় ওই কাগজে প্রবন্ধ লিখে লিখেই ভাষা-পরিকল্পনার জ্ঞানমঞ্চ সাজিয়ে বসে সমাজতাত্ত্বিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষাতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক, ব্যবস্থাপনতাত্ত্বিকের দল আজ এতটাই শিখেছেন, এতখানি হাত পাকিয়েছেন যে দেশে দেশে রাজাপ্রজা এখন তাঁদের পরামর্শ নিয়ে ভাষা-নীতি স্থির করেন। আমরা এসপেরান্তোর জন্যে কাজ করি তার মানে এ নয় যে অন্য কোনো ভাষার কারুর জন্যে আমরা নিঃস্বার্থে নিজেদের সময় আর রসদ খরচ করি না মানুষের বৃহত্তর কর্মসূচিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে।

এল পি এল পি কাগজটাতে পর পর যেসব আলোচনা হয়েছে তা থেকে খালি যে আন্দোলনের বাইরের বিবিধ পণ্ডিত (এবং তাঁদের পরামর্শ-ধন্য নানা দেশের সরকার আর জনসাধারণ) উপকৃত হয়েছেন তাই নয়। আমরা যারা এসপেরান্তো চর্চা করি তারাও ওই আলোচনাধারার ক্রমবিবর্তনে শিখেছি যে সারা দুনিয়ায় কোনো একটা ভাষা-সমস্যা নেই এবং কোনো একটা সমাধানকে সর্বত্রগামী ভাবলে সাম্রাজ্যবাদেরই নতুন কোনো আদলের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলব সকলে। এভাবে সূচনা হচ্ছে আমাদের নিজস্ব বিকেন্দ্রিকতার, নিজস্ব ভাষাগত পরিবেশতত্ত্বের, নিজস্ব অধুনান্তিক বিশ্ববীক্ষার।

সে-বীক্ষার সঙ্গে প্রচুর মিল আছে ভারতীয় মেজাজের। ভারতে মানুষ শিখেছে যে অনেক সমবায়ের লোক যদি মিলে মিশে থাকতে চায় তাহলে যে যার নিজের ঘরের স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় কাছের মানুষের সঙ্গে যা যা লেনদেন করছে সেই ভাষার চৌহদ্দিটাকে ঠেলাঠেলি করে বেশি দূর নিয়ে যাবার চেষ্টা করে ভালো ফল পায় না। ভারতের অনেক এলাকার মধ্যে যোগাযোগের কিছু কিছু প্রয়োজন হিন্দিতেই ভালো মেটে। অন্য কিছু কিছু কাজে ইংরিজির (বিশেষত কোনোরকমে জুটিয়ে নেওয়া ভাঙা ভাঙা ইংরিজির) আপাতত বিকল্প নেই; খুব শিগগির হয়তো কোনো বিকল্প তৈরিও হবে না। আবার আন্তঃপ্রাদেশিক কোনো কোনো মহলের সেতুসাধনের কাজের পক্ষে পথ-চলতি, হাটে-বাটে ব্যবহার্য খিচুড়ি ভাষা – বিহার-ঝাড়খণ্ডের সদরি কিংবা উত্তরপূর্ব ভারতের অসমিয়া-নাগা-মেশানো নাগামিজ যেরকম খিচুড়ি, সেইরকম সেতুভাষা – একেবারে অপরিহার্য। বলে লাভ নেই যে হিন্দি ইংরিজি সদরি নাগামিজের এই বৈচিত্র্য ঘুচিয়ে দিয়ে কোনো একটা সমাধান কেন্দ্র থেকে ভেবে চিন্তে সকলের উপর চাপিয়ে দিতে পারলে সকলেরই খাটনি বাঁচবে। ভাষার পরিবেশতন্ত্রের দরকার অন্যরকম। অল্পবিস্তর কৃত্রিম এই সমাধানগুলো বিভিন্ন বহরের লেনদেনের বহরমাফিক বিশেষ প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খায় বলেই তাদের বিকাশ ঘটেছে। অন্দরের স্বাভাবিক আস্ত ঘরোয়া ভাষার পাশাপাশি সদরের খানিকটা জোড়াতালি দেওয়া বে-ঘরোয়া অর্ধভাষার এই সহাবস্থান ভারতের তাপ্পি দিয়ে সামলে সামলে চলার কায়দাটারই অন্যতম নিদর্শন। ওই জোড়াতালি দেওয়ার দস্তুরের আকৃত রূপ বলে পৃথিবীর পরিবেশতন্ত্রে এসপেরান্তোকে যদি আমরা চিনতে পারি তাহলে ভারতের একান্ত নিজস্ব আধুনিক চলনরীতির সঙ্গে এই বিশ্বজনীন ভাষার প্রকল্পের আত্মীয়তা আমাদের অন্যতম সম্বল হয়ে উঠবে।

আশা করছি নিজেদের সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে সহমর্মী অনেকেই ক্রমশ দেখতে পাবেন যে, আকাশমার্গে বিচরণ করতে না চেয়ে সসীম মর্ত্যবাসী হিসেবে সেতু নির্মাণের যে-পন্থা ইহবাদী মাত্রেরই ইষ্ট, সেই পন্থার সঙ্গে এসপেরান্তোর কর্মীদের মনের মিল রয়েছে গোড়া থেকেই। সে-অর্থে এসপেরান্তো আন্দোলন ইহবাদের পথিকৃৎ বলে স্বীকার্য। প্রত্যেক দেশে যাঁরা এসপেরান্তো নিয়ে কাজ করেন তাঁরা জানেন, দেশবিশেষ বা অঞ্চলবিশেষের কর্মীদের কোনো অগ্রাধিকার নেই, সকলের উদ্যোগের সমাহারেই ক্রমশ এগিয়ে চলে জনপথের এই জনরথ। ইংরিজির রাজধানী ইংল্যাণ্ড আমেরিকায়; এসপেরান্তোর ‘প্রাজধানী’ সর্বত্র – যে-‘প্রাজধানী’ প্রজাদের পারস্পরিক শাসনবৎ সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াসের মজার নাম হিসেবে লাগিয়ে দেখছি এই বাস্তবটার গায়ে। এই লাগিয়ে দেখাগুলোই এসপেরান্তোর খালি মজার জায়গা নয়, প্রজাতন্ত্রেরও জায়গা।

যাঁদের চিন্তারীতিতে এ-আলোচনার পাশাপাশি উচ্চমার্গীয় দস্তুরমতো দর্শনের আর ভাষাতত্ত্বের মশলার আমদানি আবশ্যিক ঠেকবে, তাঁদের অনুরোধ করব আমার ২০১১-য় প্রকাশিত ‘ইনহ্যাবিটিং হিউম্যন ল্যাংগুয়েজেস’ পড়ে নিতে। কিন্তু এবার আমাদের বর্তমান লড়াইটাকে ফিরিয়ে আনতে চাইব প্রকাশ্য পরিসরের আলোচনার প্রাঙ্গণে।


।।ভি টে মা টি র   আ বা দ    আ র     প থ     চ লা।।

    কেউ কেউ ভাববেন, আমার বক্তব্য কতটা স্ববিরোধী সেটা আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি না। তাঁরা বলে উঠবেন, ‘তুমি এক মুখে বলছ জমির লড়াইয়ের স্লোগান তোলা নাকি শস্তা জনবাদ, আর অন্য মুখে বলছ ভারতীয় ভাষা আমাদের আসল ভিটেমাটি, ইংরিজি নাকি ধার-করা ভাষা। বাজে কথা ছাড়ো। তুমিও তো জমির লড়াইয়ের হয়েই সওয়াল করছ দেখতেই পাচ্ছি। তাহলে ঝেড়ে কাশো। তোমার মতলবটা ঠিক কী?’

    ঝেড়ে কাশতেই তো চাইছি। যে-পাঠক ভিটেমাটির সঙ্গে জমির তফাত বুঝতে পারছেন না তাঁকে ধৈর্য ধরে বুঝিয়েই বলব আমার বক্তব্য কী। কথাটা কাটতে চান নিশ্চয়ই কাটবেন, কিন্তু না বুঝে শুধু শুধু ঢিল ছুঁড়বেন না, তাতে আপনারও সময় নষ্ট।

আমার বন্ধু আলোক ভাল্লা উত্তরপূর্ব ভারতে কিছু দিন কাজ করেছিলেন। সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে মিশে তাঁর গান্ধিবাদ আরও স্পষ্টতা পায়। আমার কম বয়সে আলোক ভাল্লাই খেয়াল করিয়ে দেন যে, জোরের সঙ্গে নৈরাজ্যবাদ প্রচার করতে করতেই গান্ধিজি এও বলতেন যে রাষ্ট্রিক বা ব্যাপক-সামাজিক ক্ষমতার কোনো কেন্দ্রকে বাড়তে দেওয়া উচিত নয়, ওগুলোই যত নষ্টের গোড়া। কণিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বে অগাধ বিশ্বাস ছিল গান্ধিজির। তিনি বলতেন, মানুষ স্বভাবতই নিজের ঘর বাঁধতে চাইবে। ও-জায়গাটা তার একার বাড়িই হোক, তার পরিবারের যৌথ বাড়িই হোক, ওখানেই আত্মনিরূপণ করবে সে। অর্থাৎ ওই ভিটেমাটিকে রক্ষা করা তার কোনো রাষ্ট্রিক লড়াই নয়, মালিকানা-গন্ধী জমির লড়াই নয়, নিতান্তই তার ব্যক্তিগত আর পারিবারিক নিজস্বতা প্রতিষ্ঠা করবার এবং অটুট রাখবার অধিকারের সংগ্রাম, যেটাকে তার সাধনা বললেও অত্যুক্তি হয় না।
   
    ওটা তাহলে আপনার আমার সেই নিভৃত সাংস্কৃতিক জায়গা আস্ত রাখার লড়াই যেটাকে ইহবাদী অর্থে ‘দীক্ষা’ বলতে পারি; অর্থাৎ কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলে শিক্ষার যে-চালচিত্র আপনার আমার ব্যক্তিত্ব রচনার এবং বিকাশের জায়গা সেই ব্যাপক অর্থে ‘দীক্ষা’র লড়াই। এভাবে বলায় হয়তো ধরতে পারবেন কেন আমি মনে করি যে মানুষের ভাষাগত অধিকারের জায়গাটাকে নিছক মাতৃভাষার জমির আবাদের ছবিতে বা ভাষা-পরিকল্পনার নেশায় মত্ত ‘ভাষা পরিশীলন’-এর ছকে আটকে ফেললে গুরুতর অন্যায় করা হয়। মানুষের দীক্ষার অধিকার একটা ব্যাপক জায়গা। সেখানে আপন ভাষার সঙ্গে ভিন ভাষার প্রয়োজন মাফিক খোলামেলা চলাফেরা যেন অবাধ হয়, অনুবাদ যেন আপনার-আমার খবর রাখার আর জানতে পারার ঘাটতিগুলো পুষিয়ে দিতে থাকে, এ-দরকারটাও জরুরি। আবার অন্য দিকে ব্যক্তি হিসেবে আপনি-আমি যাতে আস্ত থাকতে পারি, নিজের পারিবারিক বাল্যশিক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখেই যাতে বড়ো হতে পারি, সে-অধিকারটাও এই বৃহত্তর দরকারেরই অঙ্গ। যখন আমরা বলি, খাসি বা মিজোদের ভাষাগত অধিকার রক্ষা করতে হবে, তার মানে তো খালি এ নয় যে তাঁদের ভাষাটুকু বিদ্যায়তনে দস্তুরমতো পঠনপাঠনে স্থান পাবে; এটাও জরুরি যে তাঁদের ভাষার সঙ্গে যেন ইংরজি হিন্দি বাংলা অসমিয়ার সমানে অনুবাদ চলতে থাকে।

    মেদিনীপুরে একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বলেছিলাম, মাতৃভাষায় শিক্ষাদীক্ষা লাভের অধিকার যাতে আদিবাসীরাও পান সেটা দেখা আমাদের সবারই দায়িত্ব। একজন লড়াকু বাঙালি ছাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমরা যারা নিম্নবর্গের বাঙালি তারা অনেক লড়াইয়ের পর নিজেদের অধিকার আদায় করতে পেরেছি সবে, আমরা কেন আদিবাসীদের জমি ছেড়ে দেব বলতে পারেন? সেদিন সেই ছাত্রীকে যা বোঝাতে পারিনি সে-কথাটাই আজ খুলে বলতে চেষ্টা করছি, পারছি কিনা জানি না। জবান-জমিনের আবাদের জ্যামিতি এমন নয় যে মেদিনীপুরের লড়াকু বাঙালি নিজের কষ্টার্জিত জমি ছেড়ে দিলে তবে সাঁওতাল ছাত্রছাত্রীর অধিকার আদায় করা সম্ভব হবে। অনুবাদের পথে পথে আমরা সবাই ঘুরি, একই ভাষার ভিতরেও ঘুরি, ভাষা থেকে ভাষান্তরে সেই পথ চলাটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে এই যা। শিক্ষাদীক্ষা ব্যাপারটাই যে সুগমের সঙ্গে দুর্গমের অনুবাদের কারবার, একথার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে আমাদের অনেকেরই দেরি হচ্ছে। এমনকি ভাষাতাত্ত্বিক মহলেও এ-ব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখেছি। মেদিনীপুরের লড়াকু ছাত্রীকে দোষ দিচ্ছি না। স্বাভাবিক কথা দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছে বেশ করেছে। আমাদের কাজ হল আস্তে আস্তে পুনর্বিবেচনা করে এমনভাবে এগোনো যাতে তার চোখে কিংবা আপনার আমার চোখে কী কী স্বাভাবিক ঠেকবে সেই বিচারের জায়গাটাই ক্রমশ সরে সরে যায়। সাংস্কৃতিক অগ্রগতি এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে ঘটতে পারে না।

    জমির লড়াইয়ে আর রক্তপাতে কোনো অগ্রগতি হবার নয়। কলমের ঘাম কাগজে ফেলে পরিশ্রম করার ব্যাপার এটা। অনেক উষ্ণকণ্ঠ বুদ্ধিজীবী দেখেছি লেখাপড়া করতে হবে দেখলে চম্পট দেন। এ-প্রবন্ধের পাঠকেরা নিশ্চয়ই সেরকম নন। তাঁরা নিঃসন্দেহে ধরতে পারছেন, নিজের ব্যক্তিত্বের আর নিকটতম স্বজনদের ক্রমবিকাশের যে-জায়গাটুকুকে ভিটেমাটি বলছি সেটা বাঁচাবার লড়াই মোটেই রাষ্ট্রিক বা বৃহৎ-প্রাতিষ্ঠানিক জমি দখলের সংগ্রাম নয়। পথ চলতে চলতে, অনুবাদ করতে করতে, নিজের ভাষার সঙ্গে ভিন ভাষার নিত্য কারবারের জ্যামিতি ধীরে ধীরে পালটাতে পালটাতেই এগিয়ে চলে দীক্ষায় পূর্ণতা আনবার লড়াইটা, তাকেই বলে ভিটেমাটি রক্ষার লড়াই। এ-কাজ করতে গিয়ে আমরা বুঝতে শিখি যে, বিপন্ন ভাষা বাঁচাচ্ছি বলতে বলতে বৈদেশিক টাকাকড়ি নিয়ে যেসব ডকুমেনটেশনের টিম এসে হাজির হয়, তারা যে-সওদাগরি সংস্থাগুলোর একক বা সামবায়িক অহমিকার হয়ে কাজ করছে, সেই জায়গাটা সবসময় আমাদের নিজেদের অগ্রগতির স্বার্থরক্ষার জায়গা হয়ে উঠতে পারে না। মাঝে মাঝে দোস্তি হয়ে যায় নিশ্চয়ই; ব্যক্তিগত সদিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করতে নেই; কিন্তু সদিচ্ছাপরায়ণ ব্যক্তি সরল অভিপ্রায়ের বশবর্তী হয়ে মাঝে মাঝে ফাঁদে পা দিয়েও ফেলে, তখন আমাদের খেয়াল করতে হবে যে, বন্ধুত্বের খাতিরে আমরা তাদের তালে তাল মেলাতে গিয়ে নিজেরাই যদি পা হড়কে গাড্ডায় পড়ে যাই তাহলে কিন্তু কেউ বাঁচাতে আসবে না।

    ‘আন্তর্জাতিক’ কর্মকাণ্ডের বেশধারী যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ ছেয়ে গেছে ইংরিজি ভাষায়। তাঁরা বলতে থাকেন, ইংরিজি নিয়ে যা জানার সবই নাকি জানা হয়ে গেছে, প্রশ্নটা নাকি আমাদের বিপন্ন ভাষাগুলো নিয়েই, আমরা যারা পৃথিবীর বেচারিতম লোকজন। এর জবাবে আমি তাঁদের বলতে বাধ্য হই, ‘তাই নাকি? ইংরিজি নিয়ে সব জানা হয়ে গেছে বুঝি? কই, টের পাইনি তো। ইংরিজিকেন্দ্রিক ভাষাতত্ত্বের সঙ্গে পথ চলে চলে জুতোর শুকতলা খইয়ে ফেললাম, তবু টের পেলাম না। সবকিছু কবে জানা হয়ে গেল, কোন বইয়ে বা কাগজে বেরোল সেই জ্ঞানামৃত, একটু দেখিয়ে দিন না।’

ভারতকে ইংরিজি শেখানোর অন্যতম সফলতার অকুস্থলে বলে জাহির করে কতটা বিজ্ঞাপনবাজি চলছে আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না। সারা ইউরোপ ছেয়ে গেছে গুজবে গুজবে। ওখানে গেলে শুনবেন, ভারতের নাকি সবাই ফুরফুর করে ইংরিজি বলতে পারে। সেইজন্যে এ-লেখায় ভারতে ইংরিজির অবস্থান নিয়ে এতটা কথা বাড়ালাম। সওদাগরদের পাঠানো ওইসব তথাকথিত জিজ্ঞাসুদের জিজ্ঞাসার বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম নিয়েও সন্দিহান হওয়ার প্রয়োজন আছে; তাদের সামাজিক মতলব নিয়েও প্রশ্ন করতে থাকা দরকার; আমাদের ভাষাগত ভিটেমাটি আস্ত রাখবার অধিকার রক্ষার সঙ্গে সে-দরকারটার যোগ আছে। তাই বলে জমির লড়াইয়ে আটকে যাওয়া কিন্তু কাঁচা কাজ হবে; ওই গাড্ডায় যদি পা দিয়ে ফেলি তাহলে যে সওদাগরদের পাঠানো দালালরা খুশি হয়ে হাততালিই দেবে, এটাও যাঁরা বোঝেননি তাঁরা তাহলে ধরতে পারেননি বিপদটা ঠিক কোথায়। ভিটেমাটিকে বাঁচানো বলতে যে নিজের ভাষাকে ঘিরে খোলা হাওয়ায় চলাফেরা করতে পারার অধিকারটাও বোঝায় একথাটা আভাসে ইঙ্গিতেই বললাম এখানে; সে-ত্রুটির জন্যে মার্জনা করবেন। যদি আরো খুলে বলতে চাই তাহলে অনুবাদতত্ত্বের উনিশ-বিশের ভিতরে ঢুকে যেতে বাধ্য হব। এ-যাত্রা সে-কাজ করা যাবে না। আশা করি মোদ্দা কথাটা খুলে বলতে পারলাম। এর পাশ দিয়ে পাঠকরা যে যার মতো লড়াইয়ের রসদ খুঁজে নেবেন। সে-দায়িত্ব আপনাদের। আপনাদের দম যেন ফুরিয়ে না যায়, এই শুভেচ্ছা রইল।


উল্লেখপঞ্জি

দাশগুপ্ত, প্রবাল। ১৯৯৩। দি আদারনেস অভ ইংলিশ: ইণ্ডিয়া’জ আন্টি টাং সিণ্ড্রোম। নতুন দিল্লি/ লণ্ডন/ থাউজাণ্ড ওক্স: সেজ।

দাশগুপ্ত, প্রবাল। ১৯৯৮। ইংলিশ অ্যাণ্ড ইণ্ডিয়ান ল্যাংগুয়েজেস: দা টার্ফ অ্যান্যালিসিস। আর. এস. গুপ্ত, কৈলাস এস. অগরওয়াল (সম্পা.) স্টাডিজ ইন ইণ্ডিয়ান সোশিয়োলিংগুইস্টিক্স। নতুন দিল্লি: ক্রিয়েটিভ বুকস। ২২৩-২২৫।

দাশগুপ্ত, প্রবাল; ফোর্ড, অ্যালান; সিং, রাজেন্দ্র। ২০০০। আফটার এটিমোলজি: টুয়ার্ডস এ সাবস্ট্যানটিভিস্ট লিংগুইস্টিক্স। মিউনিখ: লিঙ্কম অয়রোপা।

দাশগুপ্ত, প্রবাল। ২০১১। ছিন্ন কথায় সাজায়ে তরণী। কলকাতা: গাঙচিল।

দাশগুপ্ত, প্রবাল। ২০১১। ইনহ্যাবিটিং হিউম্যন ল্যাংগুয়েজেস: দা সাবস্ট্যানটিভিস্ট ভিজুয়ালাইজেশন। দিল্লি: (ইণ্ডিয়ান কাউনসিল অভ ফিলোজফিকাল রিসার্চ-এর হয়ে) সংস্কৃতি।

দাশগুপ্ত, প্রবাল। ২০১২। ভাষার বিন্দুবিসর্গ। কলকাতা: গাঙচিল।

Labels: ,

Sunday, March 3, 2013

The presence of English in India at the crossroads chapter 6


THE PRESENCE OF ENGLISH IN INDIA AT THE CROSSROADS
Probal Dasgupta

Kumud Chandra Dutta Memorial Lectures 1997 (Dibrugarh University, Assam)

Published as ‘The presence of English in India at the crossroads’, pp 1-132, in Probal Dasgupta, Udayon Misra, Amaresh Datta (2002) English at Crossroads: The Post-Colonial Situation: Kumud Chandra Dutta Memorial Lecture Series, 1997-98. Guwahati: Students’ Stores.

Posted here chapterwise; this is the sixth of six chapters. In the text itself I call the chapters ‘sections’ and the sections ‘subsections’.

6. The narrative basis of cognition

6.1 Self‑knowledge as potential writing

This final section, which unpacks the key notion of the Basic Narrative, investigates the implications for the humanities of a model of cognition on a reclothed planet in the sense of the earlier sections of the argument. Let us try and put the problem in terms of a question that might be faced by an individual who accepts the conclusion that an unnarrated life is not worth living. If this is how you know, such a person might ask herself, how then do you live? How do you know about living, or talk about living, or nearly write about living, or restrain yourself from writing about living? How does your very self‑knowledge have the form of a potential writing?

This question becomes vital if, as we have been arguing throughout, the potential is the real, or, as existentialism once held, truth is subjectivity.

This section is organized as follows. Subsection 6.1 sets the stage for the conceptual enterprise and summarizes the argu­ment. Subsection 6.2, Premises, reads the basic narrative in terms of a rearticulation of life, knowledge, and the novel as a metagenre. Subsection 6.3, Methods, links the risk element of the story to the semantics of Utopia and the pragmatics of Ideology. Subsection 6.4, Contexts, exemplifies some uses to which this ac­count might be put by literary critics in characterizing particu­lar types of novels. Finally, subsection 6.5, A Conclusion, wraps up the overall argument of the book, turning from the individual self to one's larger identities, including the national self.

Many contemporary accounts of the self endow it with the form of an inner dialogue or conversation. This of course we share. In our overall argument, the dialogical element in the account of linguistic knowledge LK provided in section 5 involves a dialexis with a dialectical twist. This leaves us with an unaddressed tension ‑‑ unresolved it must remain in any theoriz­ing at such an early stage of our understanding of the matters discussed here ‑‑ between the outer or "practical‑instrumental" component and the inner or "conceptual‑counterfactual" element in any account of a coherent, self‑directed life that acts out what it thinks it knows.

As we address this tension, it helps us to assume the common dialogical premise that the novel is a prototype of narrative that embodies the medley of various linguistic voices in a real arena. What we add is the new and possibly slightly perverse idea that you and I are always about to burst into a novel but kindly leave the world uncluttered for the relatively few who actually do write novels. This is in keeping with our emphasis on the element of the potential in any cognition.


Although the rest of our argument makes it important to deploy our understanding of the novel in the service of an in­creased understanding of processes of self‑imaging and identifi­cation, the structure of the move made in the present section makes it inevitable that we emphasize here the tools used. In other words we look more carefully here at the basic narrative that haunts every self as a potential novel, and less carefully at the thematics of self and identification as a whole or in dialogue with the theory of linguistic knowledge. So be it. We do wish to provide some tools of direct use for the humanities proper if greening is part of our enterprise.

I propose to characterize The Novel, then, in terms of the novel‑writing potential present in all of us. This  potential takes the form of being ‑‑ unconsciously, which is a qualifica­tion to be understood throughout ‑‑ about to burst into a novel that one keeps postponing. One says: Wait a minute. Let me first see what the others have been writing. My novel will have to make sense to them. So one keeps reading and comparing notes as one prepares to write. I would go so far as to say that  even people who actually produce novels don't get out of this waiting state simply by writing something. For what they write is never the real thing. The real novel, the perfect Making Sense,  will Hundred All Our Ninetynines. Now you see why I need Utopia to handle that level.

Now to clarify my terms. BASIC NARRATIVE: our life as an element always about to burst into novelhood. PRAGMATICS: practi­cal‑ideological principles of reading and writing which generi­cally solidify a particular novel in its genre or multiple‑genre identity. SEMANTICS: the theoretical‑utopian principles that dissolve a novel into the metageneric flow not enslaved by that novel's generic or other affiliations. This dissolving connects the flow of all novels to the basic narrative.

I propose that a semantics of utopia and a pragmatics of ideology can viably characterize the general fact of the novel ‑‑ the general relation between fictional genres such as detective fiction, adventure fiction, science fiction, romance. The specif­ic model developed here uses a pragmatics to articulate generic conventions as ideological scaffolding. In contrast, our semant­ics deals in the utopian currency providing the principle of traffic between such specifications.

We define utopia as an architectonic visualization where the parties to some explicit or tacit negotiation arrive at some settlement based on a sustainable understanding. This counterfac­tual telos, which renders intelligible all scenarios deviating grossly or minutely from the telos, is in our account rooted in the basic narrative. This for us is the bionarrative where the reader/writer spontaneously and unconsciously situates herself.

At the basic narrative interface, life shimmers into art. Our model rests on the (optional) claim that the basic narrative postulates a utopian telos as a concomitant of the self‑defini­tion of a person as a Planner. We argue that planning as an activity of handling arrays of choices and metachoices, since it subtends rationality, projects a utopia that spells out the shape of such Reason as a blueprint for valid settlements.

The advantages of such an account are twofold ‑‑ I say "such" and not "this" as I claim no special virtues for this particular implementation of what I hope is a sound programme. First, this programme in principle links fiction theory to theo­ries of choice and action in the social sciences, via the Ration­ality and Planning connection. Second, it makes fiction theory more user‑friendly if the user is a person for whom making sense of oneself as a life‑planner has some direct bearing on making sense of how and what one reads.

In pursuit of such knowledge, what gadgetry?

In plain language, inside every one of us is a saint and a goon. I call them the Cultural and the Technical. So people alternate between asking what is possible, a cultural‑utopian question, and what is practical, a technical‑pragmatic question. Politics is the art of the possible, the tricky and ambivalent negotiation between our Goons and our Saints, who seem to still want  each other to wear these saintly and ghastly faces. Polit­ics goes lumpen when it cherishes Hitler and it goes utopian when it prizes Gandhi, sorry to pretend that cartoons can be concepts, but perhaps concepts are often cartoons too, so maybe we're even.

It helps to wonder if we broach any cultural‑pragmatic or any technical‑utopian questions as well. I think we do. This has some bearing on the narrative work of novels. Bending the words Comedy and Tragedy to our purposes, let me say that tragedies are about characters pursuing utopian questions, while comedies show people exploring pragmatic ones, and that this or that mix of the cultural and the technical goes into the cuisine of genres and specific novels as individuations. We revert to these issues when the time comes. This is a glimpse of what the gadgetry can do.

6.2 Premises

I assume that we are in a postmodern period, despite the fashionableness of saying so. I even assume that the refusal to buy grand narratives characterizes the postmodern condition.

I take it that universal master narratives claiming to have all the Factual answers have abandoned us. But we have picked up this universal servant narrative. Call it Fantasy. It seems to know how to keep the Fictional questions flowing.

I'll be polarizingly cartoonish about it for expository clarity. The classical novel belonged to the period that took nations very seriously. Novels affirmed, prototypically, the na­tionally specified independent individual. (Please ignore the great Russian novels declaring that such an entity cannot come to pass under Tsarist conditions.) The postmodern novel internation­ally sings of the interdependent person, a self‑conscious mask or persona and not a principle of moral individuation. Its cross‑national flow merrily meanders into a complacently differentiated market placing some Kunderas, Rushdies, Calvinos on a certain centre‑stage, and preventing many of the real cross‑boundary flows from reaching any serious or tangible visibility. I grant this, and cannot base my reading of the flow on this market alone. But  the flow itself must be real. It is in fact so strong that even this stupid market, which compulsively tries to arrange that a tiny segment should hog a lot of the attention, ends up acknowledging the demise of the national tradition currencies.  

Hence my claim, still couched oversimply modulo future hedges and qualifications, that Fantasy does for today's interna­tionals what Reality did for yesterday's nationals.

One formal feature of Fantasy in my sense is the way it interweaves the conventions and possibilities of the fictional or creative imagination with those of factual or analytical dis­course. At the postmodern point, the distinction between fiction­al and factual writing gets blurred. One would imagine that the genres were, if not breaking down, at least in the throes of a crisis.

Does it seem perverse to claim precisely at such a moment that generic conventions matter so much that our pragmatic ac­count of ideology should examine them? Well, our move only ap­pears to fly in the face of the new imperatives.

For the novel becomes a metagenre, in such a period, and serves as the most convenient vehicle of Fantasy, the universal servant narrative. We become conscious of the ways in which different generic types of speaking and writing work for us or work on us. And we start wanting to talk about these types and their effects. Our talking needs a place where it can be carried on properly. The new novel, trying to be such a place, becomes a metageneric sea that can hold all genres of experience and make their modes available for inspection and response.

To return to the listing of premises, I take it that real life today is dealing with an explosion of types of writing. Once upon a time it may have been important to try to extend genre theory from writings to speakings. But there are all these new ways to write and send messages and submessages, with the gradual proliferation of technologies of message production, distribu­tion, transformation, and aggregation, with the often remarked incalculable and rapidly changing effects. Such writing and sending of messages raises a new question of Telling. This is not best addressed in terms of some touchingly archaic dichotomy pitting the formally dressed‑up public Writing of knowledge against the Speech of experience in an informal privacy that doffs the standard uniforms. Public power and private resistance no longer come in such simply legible packages. Hence the in­creasing difficulty of reading the old novels in terms of a speaking individual against a written society. Hence too the diminishing usefulness of theories of fiction that keep staring at those novels before they look at anything else.
But this is not to say that we can abandon theoretical continuity. We still need genres. Speech vs writing remains a useful tool ‑‑ among many others. We still need to make sense of a unique spokenness of experience or a life that precedes art. The basic narrative interface idea responds to these intuitions.

Where is my basic narrative? It is not enough to say it is in my life, for so is everything else. Where is it, more specifi­cally?

My basic narrative is at an edge. My Self‑Possession or sense of being a self who plans a life, at this edge, meets my Doors of Perception ‑‑ my conceptual need to co‑imagine others who live out the amplitude of their lives in terms which I, coming from my hang‑ups, can understand, as lives that impress me to the point of affecting the way I read my own life, its plans, its crashes. My basic narrative is at the point at which I, although about to burst into fiction, keep comparing notes with my colleagues. They and I work together towards a new Telling which no longer categorially distinguishes constructed fictions from lived lives. We posit the basic narrative because it enables us to see the non‑writers of fiction as sharing this liminal zone with each other and with the authors. This makes the basic narra­tive a useful explanatory zone.

Why should I want to write a novel? How does it matter whether I speak up or wait? Whatever the practical importance or trivialness of my looking before I leap, or my writing, or my getting published, our architectonic point here has to do with my novels as an idealized embodiment of my self‑knowledge. The reference to my fiction writing, then, serves as  a coding device in the present account. It helps me to see my validation, my self‑knowledge as a Telling I defer or relativize to other tell­ings. And self‑knowledge is where the self distances its activity from its reflexive talk. I am on edge, if you wish.

This sense of edge gives me an inside, of possibilities, and an outside world, of the actualities that my eventual real novel, which never gets written, will hit like a sledgehammer. Mean­while, and we are always in that period, the inside spells the cultural starting point where visualizations and verbal begin­nings precede actions, and the outside spells the technical zone where actions count before words do.

I assume, to complete my credo, that saints live for the cultural and always conceive of actualities in terms of the best possibilities. I assume also the existence of a Faustian pact with the Devil which sells out to what one claims are the impera­tives of practice, thus mortgaging the very existence of the cultural to a technical reading of the Scene and its realpolitik. The goon is my figure of speech representing that pact and its often ghoulish implementations. No society, no individual self‑management system, can entirely devote itself to one of these ideals. I speak thus of contradictory but equally real moments of actual existences. It would be naive to contrast this approach to any homogenizing Realism. The  postmodern zone watches, aghast, as the old realisms fail even as basic anchoring devices!

6.3 Methods

From these premises, various methodologies can follow. Here we develop one implementation.

For utopia to involve a semantics and ideology a pragmatics, we must be in the business of interpreting some meaningful state­ment. Such a statement must then occur. But a narrative, however basic, cannot stop at a speech act, not even at megaspeech. It needs to amplify its enunciation to the volume of actions that speak louder than words. For the expression‑signifier of a novel is not the vicissitudes, as in drama, but the production of content as knowledge realizable in action. In this sense, the novel harbours the duality of life and knowledge directly in its process of enunciative production. This, perhaps, constitutes the novel as the universal metagenre, and the basic narrative as the general servant narrative of our postmodern times.

Thus, the novel simultaneously produces and watches the theorization of life as knowledge. This is clear in the bildungs­roman, where the primary life of a child is shown growing into the secondary knowledge embodied as a valid cycle of interactions with a chosen community turning that child into an adult. This choosing itself is part of that child's coming of age, earning the right to choose and to reshape partners to share adulthood with. The adult is the knowledge that that cycle of interactions leading to that particular brand of maturity is one of the valid paths to Maturity or Knowledge. Since all novels feature adults, they all embody this series of gestures, if only elliptically.

Conversely, the novel both produces and watches the return of knowledge to life as life. The consumption here confirms and recycles the maturation novel's production of knowledge. That in the novel which presents play as a self‑validating principle of fun, as a core of unexplained zest for living, always bears the decipherable mark of a perceptive enjoyment. Only a human crea­ture, whose nature is to understand what it is about, can feel joy and know it is feeling this. That the mutual reflection of fun and its knowledge lock into an intense oscillation is the core fact of humanness. This process is familiar from many pas­sages where novelists of various degrees of power bring us read­ers to fountains we can or cannot drink from, depending on wheth­er our experiences and tastes, prior or expanded, allow us to partake of what is being offered.

We thus have a basic enunciation that all novels formally share. They all affirm the polarity of life as the expression and knowledge as the content of a mutual tail‑chasing process. Life matures as knowledge which reattains reality as pure, self‑perceptive joy of life. "Knowledge is content" and "Life is expression" can never occur as separate enunciations of reality. But this only begins the work of fiction theory ‑‑ or of a novel.

The work is to flow along with the question of how the mover of the process, the character in a novel ‑‑ any character, not just some central protagonist, for around every character re­volves her version of the novel, and so forth ‑‑ the question, I was saying, of exactly how such a mover of the cycle of life and knowledge proposes her particular hypothesis. Every character throws a message at the world. "How about...", says this working hypothesis, or "What if...?" And some characters are passionately involved in pushing their proposal.

How do you hold, push, sell, handle your hypothesis? Do you propose it with a clear sense of putting the idea at stake ‑‑ the sense  that the more you leave its disposal to some non‑you, the more reality you and your proposal gain? Or do you fiercely try instead to become both proposer and disposer, or equivalently to alter your context so drastically that the world, in disposing of your proposal, must do what you tell it to, because you have bent the context to your text, putting yourself at stake?

The answers to that question determine the choices I will call Comedy and Tragedy, pressing into unaccustomed service two ancient and often more rigorously defined words.

A proposer who leaves the proposal's fate to uncontrolled disposers is in a state of comedy. One who is given to trying to bring even the disposal process under control is moving into the tragic. This need not imply positive vs negative endings, of course. Comedies can end unhappily, if things don't work out, if risk‑taking ends in a crash for the character or the hypothesis. Tragedies may end up portraying apparent satisfaction, with the character pulling off the stunt of bending the world to meet the idea and  then contemplating the metaphysics of what ended up happening and what it all means at some kind of inner level, or what have you. What I am suggesting is that a comedy involves placing an idea in the world and seeing what happens. And a tragedy is about trying to turn an idea into a world and compel­ling things to take the shapes that must follow from that idea.  

Why dwell on this rather unusual version of the comedy‑tragedy distinction? I've already answered that. To repeat, I am suggesting that tragedies feature characters pursuing utopian questions, while comedies show people exploring pragmatic ones. Recall that the utopian mode involves putting the cultural first. Likewise, the pragmatic mode gives primacy to the technical. Various combinations of the cultural and the technical determine the individuality or this or that genre, this or that novel. Which means that a critic using our model can make a certain kind of sense of their individual contours in these terms.

Pragmatics in such a model is concerned about how readers follow a novel relative to what is at stake. In a tragedy, on this analysis, the whole world that is compelled to embody the proposal  is at risk. For the proposer has tried to take over the disposal process. In a comedy, what is at risk is the more limit­ed set of investments surrounding the proposal in a preexisting market which will let the hypothesis and the creatures hanging on to it either float or sink. This is going to mean two very dif­ferent sets of conventions of presentation and reading. In the sense I wish to develop, pragmatics will then give you two dif­ferent sets of ideological scaffoldings that shape your progress as a reader, and the ways you can respond to the novel.

Utopia is about the possible, visualizable settlement that provides a sky to what you see. Ideology is about the ground realities you negotiate as you make your way around a particular novelscape. I turn now to the operational notion of a context, a place which cannot exactly omit either ground or sky. But we don't yet know how to draw both ground and sky on the same map!

6.4 Contexts

Consider Adventure Novels, Spy Novels, Science Fiction, Business Fiction, Crime Fiction, Punishment Fiction, War Fiction, Tourism Fiction. What scaffoldings do readers and writers set up around such edifices to make their reading or writing work? That is the issue which I am suggesting a generically specified prag­matics that postulates an ideological groundscape can address, coupled with an unspecified semantics that handwaves at a utopian skyscape.

I begin this list with adventure and end with tourism. The adventurer, or the tourist, is a tripper, a trajector. Her risky trajectory interweaves her stakes with those of other agents, bystanders, and victims. These fellow passengers join her in co‑specifying what such trajectories mean in principle and how they work in practice.

Novels are easy to read and write when the trajectory wears a generic mask, or when the novel, equivalently, sports a readily definable action line. A theory of fiction should correspondingly find well‑defined generic conventions easy to characterize.

I am proposing that a pragmatics of ideologies should build a set of paths ready for the action network characteristic of each genre of fiction, defining the narrative ground on which the characters conduct their trips. These paths can often be defined in terms of the time‑honoured Motive, Means, and Opportunity of detective fiction for the actions themselves. But all genres do a double take and provide ring‑side seats for spectators, detec­tives, and other interested bystanders to watch and replay the actions as moral and strategic manoeuvres. These cognitive ac­tions that crucially co‑construct the novel's profile and also obey transparent generic conventions do not fall into criminolog­ical patterns quite so readily.

Thus, in a novel of crime and detection, the build‑up gives you a social landscape where the body will lie, and you admire it while you wait for the perpetration of the first spectacle. Conventions do not require suspense here. For the crime to occur at a striking or puzzling bend in the narrative contour is a plus if you get it. Why should this be so? Why are second or third murders part of the build‑up of suspense as the chase goes on? Why does the first body not have to come at the end of a nail‑biting wait? This is a question that the pragmatics I advocate is supposed to know how to handle.

I offer the following answer just to illustrate the game one is trying to play: The first crime creates a Problem which sets in motion the process of Examining the Scene, Pursuing the Agent, and Restoring Order. It is that process in which the examining, the pursuing, and the restoring agencies, often not identical, occupy protagonistic locations in the line of action and take the risks that define their individual profiles. Suspense performs its diegetic labour as part of that process. In the preambular zone of setting the problem‑stage, suspense is an option, but it is wasted on that low‑attention region, unless some author enjoys using it as an ornament.

It may be useful to compare this suspense device with the poetic device of line‑end alliteration, better known as rhyme. Alliteration at the end of a verse does an organizational job in most poetic systems. There it works on your medium‑term atten­tion. If you happen to use it at the start of a verse, as in  the fricative‑rich beginning of "Four faithful friends are all it takes / To clean your act and raise your stakes", it is an orna­mental game, not an active device. But the takes/stakes allitera­tion visibly affects how you read and write such verse. Likewise, initial suspense is of less moment than medial suspense.

I draw this parallel with rhyme to make the point that pragmatics does not necessarily connect actions to transparent motives or bring them under rational coordinations. Rhyme does not exactly flow from the material you want to express in a poem. It is a generic convention of rhymed versification, neither transparently intelligible and cost‑free, nor a totally opaque mechanical convention. It provides benefits, structuring as it does the attention and expectation patterns of the listener. And rhyme also has costs. Minor poets often end up saying weird things because the rhyme forces them to. Likewise, the need to create suspense may lead an author or a reader to plant or culti­vate a lot of false suspicions in the middle of a detective novel. Ideology is a structure of formal expectations that shape what one can see by way of content. Pragmatics provides an ac­count of such a structure in terms of possible paths that action patterns can take given the generic compulsions of the form.

How does utopia get into such an act? All this looks quite tame and familiar, doesn't it?

The utopian or principled component of the reading and writing of a novel of murder has to do with the deeper mysteri­ousness of the fact of murder as such, as a human fact. As one reads in practice yet another story of a murder, one also reads it in theory as a story of Murder. And one is moved, at the semantic or sense‑making level, to ask: What is the fact that people perform the extreme action of committing killing? How does this fact make sense under a sky which sees all grounds meet at the utopian horizon where the parties to all conflicts and dia­logues can in principle either settle them or imagine settling them?

One possible way to approach an answer is to say: It is true that the characters as portrayed in a detective novel are built around the fact of a murder. If you remove the fact, the generic conventions collapse, and no detective novel remains. So of course a utopian construal cannot intrude into the pragmatics of reading or writing such a thing without destroying the genre. And surely you cannot redeem the General Novel by destroying all the Particular Novels type by type. Having said all this, however, it is also true that novels portraying a murder go to great pains to explain who the murderer was, or who the victim was, in a way that allows us to locate the deed on a map of existing human responses to extreme situations. The conventions whereby we agree to construe killing as an intelligible response to a certain configuration are themselves under scrutiny every time a novel activates them for us. At one level, we are asking: What would it take for characters such as these to have not gone over that brink? Can we measure the distance that separates the particular configuration this novel holds up for us to look at from a slightly ‑‑ or massively ‑‑ different pattern of such lives which would not have collapsed into a murder story?

I may have made it sound as if I was talking preachingly about the undesirability of murder, and implying that novels are supposed to portray the Good Life and Morality and all that. The point, however, is about all obviousness. Generic conventions create the obvious. The obvious is ideology. Murder novels are simply a readily available example.

To see that the point is more general, try the romance genre. You don't think a utopian would be against love, do you? Well, everybody knows that the conventions of a romance, too, impose repetitive and predictable requirements which drive the mechanics whereby the writer and the reader agree to turn a romance into a quick read.  And I do want to suggest that here, as well, the utopian component of the reading and writing of a romance proceeds to ask if we know, or can learn, how to construe the particular configuration that has these people generically melting into each other's hearts and minds in terms of its dis­tance from some ideal of mature mutual visualization. To make this concrete, let us put it to you that maturity involves a serious mutuality whereby the parties to such a Harmony (not a Conflict, fine, not a Conflict) are able to read each other's life‑texts ‑‑ including what they individually can and wish to put at risk, on the basis of the compulsions which drive them but which they are beginning to modify in the light of jointly formu­lated projects ‑‑ into a serious, and therefore unstable and repeatedly negotiable, interweaving. 
Please substitute for this your favourite definition of mature mutuality; this particular definition is not my point. The point is that utopia is concerned with cancelling the excessive gentleness of dramatized sentiment exactly as it is concerned with cancelling the excessive destructiveness of dramatized hatred. Utopia, as it works in this theory, is about bringing all novels together in the flow. The basic narrative constitutes that personal edge of yours, where you are trying to understand and make sense, from your point of view, of the life‑knowledge recy­cling, embracing comic and tragic, and not excluding any of the genres. Utopia helps the basic narrative to remember to embrace all the possible genres, and to read them all as inflecting the same massive set of human issues in terms of some specific gener­ic conventions playing up some of the effects to facilitate the task of reading and writing anything at all. This is a first account.

It does not satisfy. It does not respond to the compulsions of the postmodern predicament that I reminded you of. Let us then abandon the cartoonish level, and be serious for a change. I promise you that this will be very brief.

Generic conventions exaggerate to make some kinds of intel­ligibility work efficiently. The cost is that other kinds become impossible. Postmodern work has been trying to redress the bal­ance. Fantasy is a medium in which the types of reality‑effect that characterize various genres flow into each other. How is this free flow accomplished? By placing the generic conventions themselves on the stage, as masks to be noticed together with the characters and actions they bring into visibility. One therefore exaggerates the exaggerations in magic realism and other narra­tive performances of our times. This second‑order exaggeration puts the genres themselves on the line.

Correspondingly our account must allow for metanovels where the novelistic conventions are part of what is at risk. The pragmatics of the reading/writing ground of novels of that order of complexity must place the pragmatic principles of the rela­tively naive and genre‑bound first‑order novels in the stuff that goes into the story line. You thus have secondary expectations that activate and deactivate particular packages in which primary expectations are switched on and off. Such a process of meta­switching can only be driven by an operative utopian machinery that brings the sky herself down to earth and performs hair‑raising operations on multiple grounding sites which the simple maps I have been spending most of my time on are grossly inade­quate examples of.

I think it is in this specifically postmodern context that the work I have been suggesting, of drawing pragmatic ground plus semantic sky portraits of a whole gallery of generically speci­fied contexts differentiating on the basis of shared principles of skyscaping, really gets interesting teeth. Whereupon the notions of ideology and utopia start helping us to make sense of the novels our best authors and readers have been labouring to bring forth. This, I'm afraid, is where I get out of the way. My own understanding of how these tools can be of service take you only so far. The rest of the way is a matter of travelling with the novels themselves, or with the basic narrative itself. I leave it to You, literally, if You are your basic narrative, always already stylized prior to, or coterminous with, your living itself.

6.5 A Conclusion

It is time to finish the overall argument. Now that we have explored some tools whereby an individual can look at the way she normally ‑‑ if unconsciously (a hedge whose importance Chinmoy Goswami has reminded me of) ‑‑ narrates herself into continued existence, we return to the bigger domains that she identifies with, including the nation. We have been arguing that we need to understand and strengthen processes weaning us from the nation. But there is no doubt that we are still at a stage of development that makes the nation an organizer of all our identities. It thus continues to be perceptually salient.

Indians must therefore face the question of how we are going to carry out the narrative management of our Indian identity once we become self‑conscious about the tools used in this process, like the English language.

As usual, there is no body of All Indians that can face this question together as a single general question. We are dispersed in all sorts of positions as potential narrators. Our narratorial positions have to do with what we are learners of. Only as you learn something does it come across as a fresh, new cognition. It stays with you as a moment you can revisit, and you can hand it down to others so that they face its newness the way you once did ‑‑ but there is no simply storable knowledge. We have just looked at the fact that a person's basic narrative handles knowledge in narrative terms. This must also hold at the national levels, for there is no one national level. National narratives can only work in contact with the fresh moments of learning where knowledge is alive.

In other words, we can only narrate as we learn. And no single mega‑management can manage the sprawl of all our learning. Hence the inappropriateness of the monumental Olympian nation building target that the typical twentieth century nations have been chasing. You see, or perhaps you don't see unless you want to, learnings never do add up to a cumulative knowing. Children have to start with a broken down, piecemeal box of toys only a bit different from their predecessors' toys. Toys become tools only gradually for each generation, as things add up. They add up differently each time. There is no tool to tool transmission. It is always tool to toy to tool. And, if the adults are of good cheer, tools always remain also toys. Because of this factor, the illusion of tool to tool transmission chains is not robust enough to mathematize into an aggregation of national knowledge as a single mind.

What happens when a would‑be enlightenment tries to build such an aggregation by the sheer force of teaching energies? What happens when you force the minds of children to zoom out of the toy mode into the hyperspace of tools instantly? You give them violence to promote the necessary speed. It colours their pleas­ure. They become knowing children. That knowingness is sickening not only when it is a case of the erotic gone bad. The premature­ly overschooled whiz kid syndrome produced by the knowledge sweat‑shops all over the planet parades before our initially shocked eyes a panorama of childish knowingness in all domains of knowledge. After such tools, no toys. This is the picture of the planet's cultural denudation.

Given the impossibility of aggregation, it seems likely that Indian learnings struggling to narrate themselves will do much of their work in the desirable disarray of Indian languages playing the role of learner‑friendly conversation networks. Since Indian languages are able to embody the learner position with some articulateness thanks to the colonial and nationalist past, it is going to seem natural for self‑conscious learners in India to use them that way. Recall the dialexis principle in our anti‑naturalism section. It follows from dialexis that only from the varied positions that are taken by the learner (and which remain continuously connected via the counterfactual internalized teach­er figure) can living knowledges be formulated conversationally and thus exist at all. A clearer understanding of this relation between the dialexis principle and the availability of knowledge as sparks needs to be worked out in the context of a general theory of significance that takes both literary form and abstract formalizations seriously in its proposed summations.

The option of developing knowledge production and distribu­tion cycles in all seriousness in the Indian languages them­selves, breaking the current monopoly of English in this sector, will stop looking merely theoretical, and meet obvious practical needs, once the mental life of English in India matures as a meta‑flow of knowledge‑flows aware of the Olympian, growing past its present incarnation as a confluence of simply Olympic‑achievement‑cheering knowledge‑streams with no consciousness of the unhealthiness and therefore unsustainability of the planet's Olympian enterprise. This day is not too distant. The physical life of English in India seems about to give way to the self‑distributed materialities of on‑line shooting.

What non‑utopian reasons do I have for saying this?

Begin with an empirical reason. The document or the book has been making room ‑‑ without completely disappearing ‑‑ for the movie, the song, and their cyberspace retakes. As this process waxes, the factors which have made the Indian English film indus­try lag so far behind the book business will come into their own. You see, cyberspace favours natural options that the lazy mind finds itself comfortable with. The affluent society has been busy training its products to crave physical creature comforts. But creatures do not materialize their comfort by physicality alone. This craving as it matures is becoming a thirst for mental com­forts ‑‑ and the resulting articulate body bursts into mind.

Continue with a conceptual reason. Greed inevitably sophis­ticates itself. The greedy person stops focusing physically on directly inspectable actuals and moves on to mentally expectable potentials. Now, greed and related low emotions make the crowds tick. Ergo, the evolution of greed makes it possible to give teeth to the hope once expressed by Jibanananda Das that today's instant gratification seeking crowd (today's "bilol bhir", in his Bangla) will melt away historically. Instead of aggregating as nations that watch their physical health indicators in a measured economy, then, future crowds will congregate as communities ‑‑ perhaps not quite what Gandhi would have wanted, but perhaps of the virtual or cyberspatial kind.

Even if the direct reality of wind and water is unable to attract people back out of the affluent Olympian living rooms where television watching consumers of virtuality instantiate Plato's Cave, the indirect reality that you and I find our indig­enous language as a regional set of conversations a relatively cosy subspace to inhabit will prevail over an excessively global English even within the boundaries of our nation, even within the way we tell various narratives in the various niches of our selfishness. For selfishness too is an ecosystem which diversi­fies its niches in ways we have to make friends with.

I am outlining merely an expectation about a slightly less obscene general selfishness scenario. This does not sound like something to hope for. But it is a threshold that the masses will attain, I would like to predict. "From this ridge, new peaks will rise." Once the cyberspaces regionalize, especially in the criti­cal domains of media dand educational materials as well as in the public domain of creative writing, the general level of people's willingness to be critical and therefore a free society will go up. And all else will be added unto us.

Which us? Who are we? Let us do it by place names and what we think these names carry, even if these thoughts are about to melt into unknown tomorrows. We live in what we imagine is an India that once invented the narrative as a developed form. At any rate we live in an India that continues to keep its epics and other big narratives alive. I am predicting, with some hope, that we are all set to also become a laboratory where we all realize that the persistence of English is a certain relation between us as a public and our knowledge resources as replenishable flows. As we grow into full possession of this realization, we will do the right thing and let our precious possession slip through our fingers, as all flows must. And our English will give way to an interflow of knowledge‑flows that will strike us as natural enough to tap our willingness to sustain it as part of our action of continuing to narrate ourselves into new learnings as our innermost realities.
Our wheel comes full circle, on such a telling of the story which is us. Our country gets ready to bring the story of story‑telling at a national level to an appropriate happy ending. Why an ending? Well, the national level itself is being phased out. Knowledge as such is finally going global right before our eyes. This does not take a naive aggregative form, but uses both cumu­lative and differentiative manoeuvres. And we need the full power of the humanities and the social sciences to unravel all the tangled skeins. As we learn how to face and to participate in this serious globalization of knowledge, we will find it increas­ingly obvious that the earlier and slower internationalization of the natural and formal sciences that co‑occurred with the rise of the Olympian age was merely a first draft of this larger mingling of our identities and narratives.

Needless to say, the present set of reflections on these matters is indeed very much a first draft, a comment I make with no sense of embellished understatement, but simply as the unvar­nished truth. These reflections await critical scrutiny with the usual mixture of looking forward and trepidation.



Bibliography
Boulton, Marjorie. 1960. Zamenhof: creator of Esperanto. London: Routledge and Kegan Paul.
Dasgupta, Probal. 1987. Toward a dialogue between the sociolinguistic sciences and Esperanto culture. Language Problems and Language Planning 11:305‑334.
Dasgupta, Probal. 1997. Esperanto, the theoreticals, and guestli­ness: some captions. Osmania Journal of English Studies, Theory Special Issue.
Fettes, Mark. 1991. Europe's Babylon: towards a single European language? History of European Ideas 13:3.201‑213.
Jakob, Hans. 1995. Servisto de l' ideo: 50 jaroj che Universala Esperanto‑Asocio 1908‑1958. Antwerp: Flandra Esperanto‑Ligo.
Janton, Pierre. 1993. Esperanto: language, literature, and com­munity. Tr. Humphrey Tonkin et al. Albany: SUNY Press.
Lins, Ulrich. 2/1990. La danghera lingvo: studo pri la persekutoj kontrau Esperanto. Moscow: Progreso.
Privat, Edmond. 4/1957. Vivo de Zamenhof. Rickmansworth: Esperan­to Publishing Company.
Sircar, Badal. 1988. Je aasaa kare. 282‑303, Naanaa mukh: naatxok kobitaa probondho onnaanno. [In Bangla.] Calcutta: Anjali Bose.
Sircar, Badal.1991. Ni esperu.[In Bangla.] Calcutta: Anjali Bose.
Waringhien, Gaston. (Ed.) 1948. Leteroj de L.L. Zamenhof. 2 vol. Paris: Sennacieca Asocio Tutmonda.